‘আগামীর বাংলাদেশ গড়তে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে’

জাগো জনতা অনলাইন।। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। মাদক ধ্বংস করছে তরুণদের মেধা ও সৃজনশীলতা। এতে সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে, পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে দেশে চোরাকারবারিরা মাদক আমদানি করছে। এতে বাংলাদেশে দিনের পর দিন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বাড়ছে। মাদকের কারণে বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। বর্তমানে দেশে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি পরিবার, সামাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একইসঙ্গে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে মাদককে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে যায়যায়দিন মিডিয়াপ্লেক্সে মাদকদব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ‘মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে যুব সমাজের ভূমিকা শীর্ষক’ আলোচনা সভার আয়োজন করে যায়যায়দিন ও ঝলক ফাউন্ডেশন। সেই আয়োজনে অংশ নিয়ে বক্তারা এমন অভিমত তুলে ধরেন।
যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারপারসন মনসুর আহমেদ চৌধুরী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) ও এডিশনাল ডিআইজি মো. বশির আহমেদ। বিশেষ বক্তা ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর মো. সোহেল আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঝলক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. জাহিদ আহমেদ চৌধুরী। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এটিএন বাংলার উপদেষ্টা তাশিক আহমেদ, ব্যবসায়ী ফেরদৌস খান আলমগীর, লে. কর্নেল (অব.) আনিসুর রহমান, ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইন্সটিটিউট ও হসপিটালের মাইক্রো সার্জন ডা. সজীব পাল, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) আবদুল্লাহ আল মুহিম এবং ফেরদৌস খান আলমগীর। সভাটি সঞ্চালনা করেন যায়যায়দিনের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান।
সম্পাদক শফিক রেহমান বলেন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে যুব সমাজকে মাদকের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে মাদক নিষিদ্ধ করলে মাদকের ওপর তরুণদের উৎসাহ আরো বেড়ে যাবে। মাদক নিষিদ্ধ করলেও বন্ধ হবে না, বরং মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে সচেতনতামূলক প্রচার বাড়াতে হবে। এ জন্য তিনি মাদকের বিরুদ্ধে পারিবারিক শিক্ষা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধান অতিথি টিআইবির চেয়ারপারসন মনসুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, মাদক বিরোধী দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাদকাসক্ত হয়ে সন্তানরা বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে। বাবা-মাকে জিম্মি করে অর্থ-সম্পদ নিচ্ছে। মাদকের কারণে কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হয়েছে। নেশাগ্রস্ত হয়ে কিশোররা বিভিন্ন অপকর্ম করছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বললেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন।
তিনি আরো বলেন, মাদকের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়। দেশের মাদকাসক্ত চিকিৎসার জন্য খুব বেশি হসপিটাল নেই। একটি পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হলে তার চিকিৎসা করতে গিয়ে পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ জন্য মাদকের অবাধ বিস্তার রোধে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) ও পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি বশির আহমেদ বলেন, দিন দিন মাদক বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। এখনই মাদক প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপথগামী হতে পারে। এমনকি মাদক দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে। কারণ তরুণ ও কিশোর প্রজন্ম, শিশু, এমনকি নারীদের মধ্যেও মাদক সেবনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তার মতে, তরুণ ও যুব সমাজকে মাদক প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। মাদক কারবারিদের গ্রেফতার, সাজা হচ্ছে, তারপরও মাদকের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। তবে তিনি আশাবাদী, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশ ও সমাজ থেকে মাদক নির্মূল সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জনবল খুবই কম। তাই এই সংস্থাটির পক্ষে পুরোপুরি মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যে কারণে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া প্রত্যেকের উচিত প্রত্যেক জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো।
প্রধান বক্তা বিজিবির অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর সোহেল আলম বলেন, বিজিবি শুধু সীমান্তই পাহারা দেয় না, একই সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ সময় তিনি চলতি বছরে এ পর্যন্ত বিজিবি কর্তৃক জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য এবং মাদক কারবারি গ্রেফতারের তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিজিবির অভিযানের কারণে মাদক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই দেশ মাদকের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে। বিজিবিকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান মেজর সোহেল আলম।
ঝলক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. জাহিদ আহমেদ স্বাগত বক্তব্যে বলেন, মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দীর্ঘদিন ধরে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এর জন্য বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনারের আয়োজন করেছি। আমরা তরুণদের সঙ্গে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে চাই। সেখানে আপনাদের সবার সহযোগিতা কামনা করছি। একই সঙ্গে আমাদের সন্তানকে দুর্নীতি ও মাদকমুক্তভাবে গড়ে তুলতে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই।
এটিএন বাংলার তাশিক আহমেদ বলেন, মাদক নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। শিক্ষার্থীরা এখন বেশি মাদকাসক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তারা মাদক সেবন করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের নেশার সর্বনাশা পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে।
ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইন্সটিটিউট ও হসপিটালের মাইক্রো সার্জন ডা. সজীব পাল বলেন, নেশাগ্রস্ত সন্তানদের মাদের কাদতে দেখি। মায়েরা বলেন, ভালো রেজাল্ট করা একজন সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে জীবনের সব হারিয়ে ফেলছে। পরিবারকে নেশার টাকার জোগান দিতে ধ্বংস করছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদক এখন সমাজের মরণব্যাধি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) আবদুল্লাহ আল মুহিম বলেন, মাদকের ভয়াবহতা আমরা সবাই জানি। তারপরও বিভিন্ন সংকটে হতাশায় তরুণরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আমরা তরুণরা বিকল্প উপায় কাজে লাগিয়ে মাদকমুক্ত নতুন দেশ গড়তে চাই।
বাংলাদেশ নিউজ এডিটরস গিল্ডের সভাপতি বাদল চৌধুরী বলেন, চোরাকারবারিরা অন্য দেশ থেকে ক্ষতির মাদক দেশে আনছে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে। সন্তানদের মাদকের ছোবল থেকে বাচাতে পরিবারকে সময় দিতে হবে। মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাবগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।