ঢাকা | অক্টোবর ২৮, ২০২৫ - ১১:৪৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

২৮ অক্টোবর ২০০৬: লগি-বৈঠার তাণ্ডবে পল্টনে বয়ে যায় রক্তের স্রোত

  • আপডেট: Tuesday, October 28, 2025 - 11:45 am

জাগো জনতা অনলাইন।। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সেদিন পল্টন মসজিদের গলিতে লগি-বৈঠা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয়েছিল স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ অনার্স তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র হোসাইন মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামকে। আওয়ামী তান্ডবে শাহাদাত বরণ করেছিলেন ঢাকা কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন।

রক্তাক্ত ২৮-এর সেই দিনে শাহাদাতের মিছিলের আরেক নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্র শহীদ আবদুল্লাহ আল ফয়সাল। রক্তাক্ত ২৮-এর এই মিছিলের আরেক সাথী ছিলেন শহীদ মু. রফিকুল ইসলাম। লগি-বৈঠার তান্ডবের শিকার হয়ে লাশের মিছিলে সেদিন শামিল হয়েছিলেন তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম। মুজাহিদ, শিপন, ফয়সাল, রফিক সবারইতো স্বপ্ন ছিল একটি স্বপ্নিল জীবন গড়ার। একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কলঙ্কিত দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম দিন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। সেদিন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপর পৈশাচিক হামলা চালিয়ে ছয় নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় তৎকালীন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াতের অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি ধরে যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক সরকারি অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবলীলা।

সেদিন কী ঘটেছিল?
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার তখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেদিন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের শপথ হওয়ার কথা ছিল। তিনি যেন শপথ নিতে না পারেন সেজন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট আন্দোলন করছিল।

আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কে এম হাসান দায়িত্ব নেবেন না- এমন একটি গুঞ্জন আগেই তৈরি হয়েছিল। ২৭ অক্টোবর রাতে কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

কেএম হাসান এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেন যে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সংলাপে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেননি। বিচারপতি কেএম হাসান অপারগতা প্রকাশ করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করে।

এমন অবস্থায় ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয় জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল শ্রমিক দলও।

পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেদিন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে গুলি এবং লগি-বৈঠা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় ডজনখানেক নেতাকর্মীকে পিটিয়ে মারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যা ভীষণ আলোড়ন তৈরি করেছিল। ২৮ অক্টোবরের আগের দিন এবং পরের দিনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘাত হয়েছিল।

জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ শেষ হওয়ার পরও নারকীয় আক্রমণ চলতে থাকে। একটা পর্যায়ে শত শত নেতাকর্মী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর আক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ার আশংকায় শংকিত হয়ে ওঠেন তারা। এরপর জামায়াত নেতৃবৃন্দ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়েই বিডিআরকে ঘটনাস্থলে আসার কথা বলেন। বিডিআর ঘটনাস্থলে আসার পরই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতা বিশ্ব বিবেককে আঘাত দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে বিবেকবান সকল মানুষকে। রাজনৈতিক সমাবেশ ভণ্ডুল করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা বিরল। যা এখনো হাজার হাজার মানুষকে কাঁদায়।

২৮ অক্টোবরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন।