লামা মডেল মসজিদ চাকচিক্যতার আড়ালে অনিয়ম দুর্নীতি

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, লামা (বান্দরবান)।। ‘আধুনিক নির্মাণ স্থাপত্যের চাকচিক্যতার আড়ালে ভয়াবহ অনিয়ম দুর্নীতি। কাজের শুরুতেই কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। সুরম্য এই মসজিদ শুধু মসজিদই নয়, এটি ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এই কমপ্লেক্স ভবনের প্রতিটি ইটের গাঁথনিতে রয়েছে অবহেলা-অনিয়মের ছাপ। ওপেন স্পেস থেকে ছাদ ফেটে নিচে পানি পড়া, টাইলসে দুর্বল ফিনিশিং, জানালা-দরজায় ব্যবহৃত কাঠে ফাঁকিবাজিসহ মন্থরগতিতে চলা কাজে ব্যাপক অসঙ্গতি দৃশ্যমান।’
লামা উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণকাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ নীরব। সরকারের গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশল শাখার নির্লিপ্ততায় কাজের গুণগত মান খারাপ হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। যাদের সংশ্লিষ্টতার অভাবে কাজের মান খারাপ হয়েছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি উঠেছে। ইতিমধ্যে মডেল মসজিদকে ঘিরে মুসল্লিদের মাঝে হতাশার সুর ধ্বনিত হচ্ছে। মসজিদ নির্মাণে দৃশ্যত প্রতিটি কাজে ভয়াবহ ত্রুটিপূর্ণতা রয়েছে। ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মডেল মসজিদটিতে নিম্নমানের কাজ হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। যার ফলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন। এরই মধ্যে মসজিদের পূর্বাংশে ওপেন স্পেসে ফাটল ধরেছে। ছাদের পানি ঝরার দৃশ্যটি কাজে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ দিচ্ছে। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জোড়াতালি দিয়ে দুর্নীতির ক্ষত আড়াল করার চেষ্টা করেন। মসজিদের প্রতিটি ছাদ ঢালাইয়ে ডিজাইন অনুযায়ী পুরুত্ব কতটা ঠিক আছে—জনমনে সে প্রশ্নটিও এখন জেগেছে। মসজিদের নির্মাণকাজে শুরু থেকে ধীরগতি একটি বড় সমস্যা ছিল। ফলশ্রুতিতে স্থানীয়ভাবে কাজের মনিটরিং তেমন একটা হয়নি। এছাড়া শব্দযন্ত্রে আওয়াজ প্রতিধ্বনি হওয়ায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না সুরা কেরাত ও ইমাম সাহেবের কথাবার্তা। সাউন্ড সিস্টেম আরও উন্নত করার দাবি জানান মুসল্লিরা। মসজিদে প্রবেশের সিঁড়ি অনেক উঁচু হওয়ায় বয়স্ক মুসল্লিদের প্রবেশ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। জানালা-দরজা, গ্রিল ফিটিং, টাইলস, বৈদ্যুতিক পাখাসহ প্রতিটি কাজে দুর্নীতির ছাপ দৃশ্যমান। জানালা-দরজায় নিম্নমানের কাঠ ব্যবহারসহ অজুখানায় বসার স্থানটিতে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। দরজায় যেসব ম্যাগনেট ফিটিং করা হয়েছে তাও নিম্নমানের হওয়ায় স্বাভাবিক খোলা-বন্ধ হচ্ছে না।
স্থানীয় মুসল্লিরা জানান, একটি নিরপেক্ষ প্রকৌশল বিভাগ দ্বারা সরেজমিন তদন্ত করানো হলে লামা উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণে অনিয়মের ভয়াবহতা ধরা পড়বে। তারা মনে করেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জনগণের স্বপ্নের এই উন্নয়ন প্রকল্পটিকে যেন ‘দুর্নীতির দুঃস্বপ্ন হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করছে'(!)। নির্মাণশৈলীর নান্দনিক স্থাপত্য এই মডেল মসজিদ ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে। মসজিদ কমিটির জনৈক সদস্য জানান, কাজে ৩৯টি ত্রুটি রয়েছে। এসব ত্রুটিগুলো কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ রাঙামাটি সার্কেলের প্রকৌশলী সুমিত জানান, ‘প্রকল্পে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হলে কাজ বুঝে নেব না। ছোটখাটো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে।’ মি. সুমিত আরও জানান, বিদ্যমান ত্রুটিগুলো নোট করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লামার জাহাঙ্গীর সাহেবকে দেওয়া হয়েছে, তিনি সেটা ধরে কাজ করিয়ে নেবেন। এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লামা শাখার উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, উপজেলা মডেল মসজিদের যাবতীয় সমস্যা এবং নির্মাণকাজে নানা ত্রুটি-অনিয়মের বিষয়ে জানার বা বুঝে নেওয়ার জন্য আমাকে এখন পর্যন্ত কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
লামা উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবু হানিফ জানান, এ ধরনের অনিয়ম হওয়ার কথা না। পানি ঝরার বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে বলে ঠিকাদার জানিয়েছেন। তবে অন্যান্য ত্রুটি থাকলে তাও সুষ্ঠুভাবে করে দিতে ঠিকাদারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
লামা উপজেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মঈন উদ্দিন জানান, এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ কাজ করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেননি। তিনি আরও বলেন, অসম্পন্ন কিংবা ত্রুটিপূর্ণ কাজ আমরা বুঝে নেব না। ত্রুটিগুলো কী, কেমন—সে দিকগুলো তালিকা করে তাঁকে দেওয়ার আহ্বান জানান। সুতরাং কাজের অনিয়ম থাকলে সেটি ঠিকঠাকমতো আদায় করে নেব।
মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, মসজিদের কাজে ৩৯টি ত্রুটিপূর্ণ দিক আছে, যা আমরা কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছি।