ঢাকা | ডিসেম্বর ৪, ২০২৪ - ২:৫৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

তাঁত বোর্ডে দুর্নীতি, জিএম’র খুঁটির জোর কোথায়?

  • আপডেট: Thursday, October 10, 2024 - 8:43 pm

আব্দুস ছামাদ খান, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধিঃ তাঁতবোর্ডে অনিয়ম,দূর্নিতি, কমিশন বানিজ্য সহ সূতা, রং ও বাসায়নিকদ্রব্য আমদানীর ক্ষেএে তিন সদস্যের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে দেশের তাঁতশিল্প ধংসের পথে।

 

সিন্ডিকেটের মূল সদস্য তিনজন তাঁতবোর্ডের জিএম কামনাশীষ দাস, গত ৬ বছরে বোর্ডের তিন বারের অবৈধ এডহক কমিটির সভাপতি ও তাঁত বোর্ডের _*জাতীয় তাঁতী সমিতির সাবেক সভাপতি মোঃ মনোয়ার হোসেন ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর এপিএস এমদাদুল হক (দাদু)। এমদাদুল হক এখন পলাতক থাকলেও সিন্ডিকেট এখনও রয়েছে।

জিএম কামনাশীষের হাত এতই লম্বা যে, তাঁতবোর্ড ও মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা তার হাতের মুঠোয়। তার বিরুদ্ধে সাধারন তাঁতীরা শত অভিযোগ দিলেও কাজে আসছেনা।এই সিন্ডিকেটের কারণে দেশের তাঁতশিল্প ধংসের পথে। সারা দেশের তাঁতীরা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসের দুর্নীতির ও অনিয়ম শুধু তাঁত বোর্ডেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি যে তাঁত বোর্ডে চাকরি নিয়েছেন সেখানেও ভুঁয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁত বোর্ডের আগে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে চাকরিরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের তাঁতি সমাজ বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ প্রদান, স্মারকলিপি পেশ এবং তদন্ত কমিটি হলেও এখনও বহাল তবিয়তে আছেন কামনাশীষ দাস। এখন ভুক্তভোগী তাঁতী সমাজ প্রশ্ন তুলছে জিএম দুর্নীতিবাজ কামনাশীষের খুঁটির জোর কোথায়?

 

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর সহকারী পরিচালক ( প্রশাসন) মো. ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ পত্র দেওয়া হয় চেয়ারম্যান বরাবর। অভিযোগ পত্রে কামনাশীষ দাসের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে বলা হয়, কামনাশীষ দাস বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক পদে আবেদন করার সময় নিজেকে সিনিয়র রিসার্চ অফিসার হিসেবে পরিচয় প্রদান করেন এবং তিনি তৎকালীন পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের নিকট হতে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র নিয়ে উক্ত আবেদন পত্রের সাথে অভিজ্ঞতার সনদপত্র সংযোজন করেন।

কামনাশীষ দাস বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা পদে ২০০৭ সালে নিয়োগ লাভ করেন এবং ২০১০ সালে ডিপিসি সদস্যদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎকোচ প্রদান করে বিধি-বহির্ভুতভাবে সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন।

দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ রেশম গবেষকগণ ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের তৎকালীন পরিচালক মো. জামাল উদ্দীন শাহ্ (যুগ্মসচিব)এক অফিস আদেশের মাধ্যমে কামনাশীষ দাস এর সিনিয়র রিসার্চ পদের পদোন্নতি বাতিল করে তাকে গবেষণা কর্মকর্তা পদে প্রত্যাবর্তন করান।

কামনাশীষ দাস সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পদের পদোন্নতি বহাল রাখার উদ্দেশ্যে বাদী হয়ে সরকার তথা পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সহ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিবাদী করে মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং ৮৪৪৪ অব ২০১৩ মামলা দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৫ সালের ১লা জুলাই তারিখে মামলাটির রায় ঘোষণা করে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক মামলার রায় সরকারের অনুকূলে প্রদান করা হয়।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়, কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেড, চন্দঘোনা, রাঙ্গামাটি জেলার সম্পত্তি তাঁর নিজস্ব বাহিনী দিয়ে দখল পূর্বক উক্ত স্থানের চাকমা, মার্মা উপজাতী এবং প্রভাবশালী স্থানীয়দের কাছে জনপ্রতি ৫০.০০০/- টাকা নিয়ে জমি বরাদ্দ প্রদান করায় কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেড বাদী হয়ে ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিলে রাঙ্গামাটি জেলা জজ কোর্টে কামনাশীষ দাস এর বিরুদ্ধে সিভিল- ১৫৪/০৯ মামলা দায়ের করে। মামলাটি বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলা জজ কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

অভিযোগ পত্রে আরো বলা হয়, আদালতে বিচারাধীন মামলা দুইটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসকে প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের পদ থেকে প্রত্যাহার এবং আদালতে বিচারাধীন সরকারি মামলা থাকায় তাঁর সকল গোপনীয় তথ্য তদন্ত পূর্বক তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

গত ১ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাষানটেক বেনারসি প্রকল্পের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে বেনারশি পল্লীর তাঁতীরা
বিক্ষোভ মিছিল করে। ঐ বিক্ষোভ মিছিলে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য, স্লোগান ও ব্যানার প্রদর্শিত হয়। উপদেষ্টা ও সচিবের সামনেই তারা অভিযোগ করেন কামনাশীষ দাসের বিরুদ্ধে। তারা বলেন, গত ১২ বছরে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে কামনাশীষ দাস।

মীরপুর ভাষানটেক প্রকল্পে কামনাশীষ দাসের ঘুষ বাণিজ্য সম্পর্কে কথা বলেন ঐ এলাকার তাঁতী সমিতির সভাপতি হাজী ছাত্তার। তিনি বলেন, কামনাশীষ এর মতো খারাপ অফিসার বোধ হয় সরকারের কোন বিভাগে আর নেই। তাঁত বোর্ডে যত দুর্নীতি হয় তার নেপথ্যে থাকে কামনাশীষ দাস। দুই বছর আগে বেনারসি পল্লি’র মধ্যে ৯ বিঘা জমির ওপর মেলার কথা বলে ১৫০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১ লাখ টাকা করে নিয়েছিল কামনাশীষ দাস ও হানিফ নামের একজন ব্যবসায়ী। হানিফ কিছু লোকের টাকা ফিরে দিলেও কামনাশীষ কাউকে টাকা ফেরত দেননি বলে তিনি অভিযোগ করেন। বলা যায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের টাকা ফেরত পাননি। সাত্তার বলেন, তাঁত বোর্ডের ৯ বিঘা জমি নাম মাত্র ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে ৩/৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন জিএম ও ব্যবসায়ী হানিফ। এর আগে তাঁতীদের মাঝে ৯০০ প্লট দেবে বলে আড়াই কোটি টাকা নেওয়া হয়েছিল সে টাকারও হদিস নেই।

জিএম কামনাশীষ দাস ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি সিন্ডিকেটের কারণে সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের মূল্য তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গত ১০ বছরে দেশের ৬০ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে যায়,বেকার হয়ে পড়ে ১৫ লাখ তাঁতশ্রমিক। এসব তাঁত মালিকরা বাধ্য হয়ে তাঁত বন্ধ করে অন্যান্য পেশায় চলে যায়, বেকার তাঁতশ্রমিকরা ভ্যান-রিকসা চালাচ্ছে, অধিকাংশই চলে গেছে শহরে । কেউ বা গার্মেন্টসে কাজ করছে।

গত ৭-৯-২৪ইং তারিখে “ধ্বংসের পথে তাঁতশিল্প,
দেশের ৬০ ভাগ তাঁত বন্ধ, ১৫ লাখ শ্রমিক বেকার”
শিরোনামে দৈনিক সংগ্রামে তাঁত বোর্ডের দুর্নীতি নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সে প্রতিবেদনে তাঁত বোর্ডের দুর্নীতি নিয়ে জিএম কামনাশীষ দাশ বলেছিলেন, এখানে দুর্নীতির কিছু নেই। যে সকল সমিতির অনুকূলে সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির অনুমতি বা সুপারিশ দেয়া হয় তাদের যোগ্যতা থাকতে হয়। যোগ্যতা সম্পন্ন সমিতিগুলো আবেদন করলে নীতিমালা অনুযায়ী তাদের সুপারিশ করা হয়। এসব শর্ত পূরণ করতে পারলে তাদের ফেরানো হয় না।

তিনি বলেন, সমিতির ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সমিতির সদস্য সংখ্যা, সমিতির আকারসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করেই সুপারিশ দেওয়া হয়। এডহক ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কামনাশীষ দাশ বলেন, এ বিষয়গুলো তাঁত বোর্ড দেখে না। মন্ত্রী পর্যায়ে বা সরকারের উচ্চ পর্যায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন।