ঢাকা | ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৫ - ১২:৫৬ অপরাহ্ন

শিরোনাম

জলাশয় না বাঁচলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না : পরিবেশ উপদেষ্টা 

  • আপডেট: Monday, February 3, 2025 - 3:15 pm
স্টাফ রিপোর্টার : কোনো শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে সেই শহরের মোট ভূমির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। তিন দশক আগেও ঢাকায় অন্তত ২০ শতাংশ জলাভূমি ছিল, কিন্তু কমতে কমতে এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩ শতাংশে। দখল-বেদখল, অপব্যবহার ও অপরিকল্পনায় নগরের বেশিরভাগ জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে, যা ঢাকাকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে দুর্যোগের দিকে। জলাভূমি ভরাট বন্ধ করার পাশাপাশি মৃতপ্রায় জলাভূমিগুলো পুনরুদ্ধার না করা গেলে ঢাকা পুরোপুরি বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে নগরবাসীর সম্পৃক্ততায় এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ‘নতুন ঢাকা’ গড়ে তোলা সম্ভব বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব জলাভূমি দিবসকে উপলক্ষ করে রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনে ‘রি-ওয়েট ঢাকা’ শীর্ষক এক সংলাপে এসব কথা উঠে আসে। এতে স্থানীয়দের নেতৃত্ব ও অংশীদারীত্বে জলাভূমি পুনরুদ্ধারের প্রকল্পের ধারণা উপস্থাপন করা হয়।
সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, জলাশয় না বাঁচলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। একটু বৃষ্টি হলে শহরের অনেক এলাকা ডুবে গিয়ে কক্সবাজারের রূপ ধারণ করে। খাল বা জলাধার পুনরুদ্ধার করা গেলে এই অবস্থা বদলাবে। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা ঢাকা শহরের ১৯টি খালকে দখল-দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। দুঃখজনক বিষয় হলো, ৫৩ বছরেও এই শহরে কার্যকর স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। খালগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। মরে যাওয়া খাল খনন করতে গেলে সেখানে তোষক-বালিশ বা প্লেট-বালতি পাওয়া যায়। এক-দেড়বছরে আমরা এই সামগ্রিক চিত্র বদলাতে পারব না, তবে সমাধানের পথ দেখাতে পারব। স্থানীয় জনসাধারণের সম্পৃক্ততা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেক বা খালের পাড়ে শাকসবজির আবাদ করা হলে যেমন সেখানকার পরিবেশ ভালো থাকবে, তেমনি তা খাদ্যের চাহিদাও অনেকাংশে মেটাবে।
‘রি-ওয়েট’ মূলত যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের অর্থায়নে তৈরি একটি গবেষণা-ভিত্তিক উদ্যোগ, যা ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড এবং বাংলাদেশের রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ কনসালট্যান্টস নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। এর আওতায় ঢাকার গুলশান-বনানী লেকের একটি অংশ পুনরুদ্ধারে কাজ করা হচ্ছে। করাইলের স্থানীয় নগর কৃষি সংগঠন নগর আবাদ-এর মাধ্যমে লেকের পাড়ে কৃষিকাজ ও প্রায় ৩০ ধরনের শাকসবজির আবাদ করা হচ্ছে। এতে পানির গুণগত মান উন্নত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং করাইলবাসীর জন্যও নতুন এক কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। সেখানকার বাসিন্দা যারা কৃষি কাজে দক্ষ, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এটি একটি টেকসই মডেলে পরিণত হবে বলে আশাবাদী ‘রি-ওয়েট’ এর গবেষকরা। এই দলে রয়েছেন ড. তানজিল শফিক, ড. ইফাদুল হক এবং সাইফুল্লাহ খালেদ।
সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার, সুইডেনের দূতাবাসের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রথম সচিব নায়োকা মার্টিনেজ-ব্যাকস্ট্রোম, সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা এ এস এম মারজান নূর।
রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, আমাদের সংস্থার জনবল ১২ শ’ থেকে ১৩ শ’ জন। অথচ ঢাকার বাসিন্দা প্রায় দুই কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার একটা নগরকে সম্পূর্ণভাবে দেখভাল করা রাজউকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। নাগরিকদেরও গুরুদায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে সচেতন হলে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য নগরে রূপান্তর করা সহজ হবে। রি-ওয়েট প্রকল্পের যে ধারণাটি উপস্থাপন করা হলো, আমরা এতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করব।
সুইডেন দূতাবাসের প্রথম সচিব নায়োকা মার্টিনেজ-ব্যাকস্ট্রোম বলেন, জলাভূমি একটা নগরের কিডনির মতো। ঢাকার কিডনি এখন ডায়ালাইসিসের পর্যায়ে চলে গেছে। এই অবস্থার থেকে ঢাকাকে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। হাতিরঝিল প্রকল্প এক্ষেত্রে একটি ভালো উদাহরণ, তবে একমাত্র উদাহরণ নয়। আজকাল উন্নয়ন বা সংরক্ষণের কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে সবকিছু কংক্রিটে ঢেকে দেওয়া হয়। এই ধারণা বদলাতে হবে, পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ বলেন, ঝিল আর বাগ, অর্থাৎ খাল বা লেক এবং বাগানে বেষ্টিত, মাঝেমধ্যে কিছু অংশে বসতি —এই ছিল আমাদের আশির দশকের ঢাকা। মতিঝিল, হাতিরঝিল, সবই ঝিল ছিল। শাহবাগ, শামীবাগ বাগান ছিল। এরপর ধীরেধীরে লেক ভরাট হলো, বাগানও হারিয়ে গেলো। গত দুইবছরের তীব্র গরমের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। শহরে জলাভূমি ও সবুজের আচ্ছাদন কমে যাওয়ার ফলেই কিন্তু আমাদের এই দুর্গতি।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের উপদেষ্টা এস এম মারজান নূর বলেন, আমরা দেখছি ঢাকা সবসময় বায়ুদূষণে শীর্ষে থাকে। জলাভূমি উদ্ধার করা হলে তা বায়ুর মান ও সার্বিক পরিবেশের উন্নতিতে প্রভাব ফেলবে। খালবিল ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রতিবছর বর্ষায়ও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। সেই দুর্ভোগ থেকেও পরিত্রাণ প্রয়োজন।
মূল প্রবন্ধে গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের সহকারী অধ্যাপক স্থপতি ড. তানজিল শফিক বলেন, শেষ কবে শহরে সাঁতার কেটেছেন, বলতে পারবেন? দোকান থেকে ফল না কিনে গাছ থেকে পেড়ে খেয়েছেন? আমরা হয়তো ভাবি এমনটা শুধু গ্রামে সম্ভব, শহরে সম্ভব না। কারণ, প্রকৃতি আর নগরায়নকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। অথচ প্রকৃতি রক্ষা করা গেলে আমরা যে সুফল পাই, তার মূল্য অনেকবেশি। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ঢাকা শহরের জলাভূমিগুলো রক্ষা করা হলে সেটি প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সুফল দেবে। টাকার অঙ্ক উল্লেখ করছি এই কারণে যে, আমরা মনে করি প্রকৃতি ও অর্থনীতির একধরনের বৈপরীত্য রয়েছ। বাস্তবে তা নয়। খুব বেশি দূরে তাকাতে হবে না, আমাদের আশপাশের অনেক দেশও প্রাকৃতিক সম্পদ ও জলাভূমি রক্ষায় অনেকবেশি সচেতন। সেখান থেকেও আমাদের শেখার আছে। আমাদের নগরে স্থানীয় নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে সামাজিকভাবে ন্যায্য, টেকসই ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধানের দিকে হাঁটতে হবে।
আলোচনার এক পর্যায়ে রি-ওয়েট প্রকল্পের ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই ওয়েবসাইটে পানি ব্যবস্থাপনা বা জলাধার পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত ৫০০টি গবেষণাপত্র যুক্ত হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের প্রতিটি কাজ সবিস্তারে উল্লেখ করা আছে। ওয়েবসাইট উদ্বোধনের পর রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ প্রথম সেশনের সমাপনী বক্তব্যে পুরো প্রকল্পের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি ঢাকার জলাভূমি রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমর্থন, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
দ্বিতীয় সেশনে প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান, কমিউনিটি আর্কিটেকচারে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারজয়ী স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম-সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, হাওর অঞ্চলবাসীর আহ্বায়ক জাকিয়া শিশির, নগর আবাদের নগর-কৃষক শহিদুজ্জামান শ্যামল, ইয়ূথনেট গ্লোবালের সদস্য সোহানুর রহমান প্রমুখ। এতে উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রি-ওয়েট প্রকল্পে আরও সহযোগিতা করেছে রিভার্সিং এনভায়রনমেন্টাল ডিগ্রেডেশন ইন আফ্রিকা অ্যান্ড এশিয়া (রিডা), ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি) এবং ইউকে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। কনসোর্টিয়াম মেম্বার হিসেবে আরও রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড, শেফিল্ড হ্যালাম ইউনিভার্সিটি, স্মিথ কলেজ, নগর আবাদ, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস এবং প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন।