ঢাকা | নভেম্বর ২৪, ২০২৪ - ৮:০৫ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল মজুদ আছে যে ১০টি দেশে

  • আপডেট: Monday, July 3, 2023 - 6:40 am

মো: খাইরুল আলম খানঃ বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে শিল্পায়নের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আর শিল্পায়নের কথা উঠলেই সবার আগে আসে জ্বালানি তেলের কথা। মধ্যপ্রাচ্য কেবল জ্বালানি তেল বিক্রি করেই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। আরেক দিকে আমেরিকার ক্ষমতার মুখ্য উৎস এই জ্বালানির মজুত।
সত্তরের দশকে পেট্রোডলারের রাজনীতি বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। ডলার ও জ্বালানির আধিপত্যে সৌদি ও যুক্তরাষ্ট্রের মেলবন্ধনের ওপরে নির্ভর করেছে বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছু।
যখনই জ্বালানি প্রসঙ্গ উঠেছে, তখনই প্রশ্ন উঠেছে কার ভান্ডারে আসলে কতটুকু তেল আছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের দ্বিধা-বিভক্তি ও সংকটের মধ্যে জ্বালানির বিষয়টি বারবার মুখ্য হয়ে উঠেছে।

করোনার সময়ে ২০২০ সালে এপ্রিলে সৌদির ইচ্ছা ছিল তেল উত্তোলন কমিয়ে দাম ঠিক রাখা। কিন্তু ওপেকভুক্ত অনেক দেশ এবং রাশিয়ার সিদ্ধান্ত ছিল উত্তোলন না কমিয়ে কম দামে তেল বিক্রি করা। ছাড়ে তেল কেনা যাবে এমন খবরে সবাই আরও বেশি বেশি তেল কিনবে- এটাই ছিল তাদের যুক্তি।

কিন্তু দেদারসে তেল উত্তোলন করায় করোনাকালে এবং ২০২১ সালে তেলের দাম অনেক বেশি কমে যায়। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ওপেক প্লাস তেল উত্তোলন সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা চলতি বছর থেকে কার্যকর হচ্ছে। ওপেকভুক্ত দেশগুলো চলতি বছর মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈশ্বিক দৈনিক উৎপাদন ১৬ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তেল উত্তোলন কমিয়ে আনলে বিশ্ব বাণিজ্যে বড় রকমের প্রভাব পড়বে; এমন বিশ্বাসে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কার কাছে আসলে কত তেল আছে?

তেল উত্তোলনকারী শীর্ষ ১০ দেশ

১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

তেল উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশের তালিকার শুরুতেই আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনসট্রেশনের (ইআইএ) তথ্যনুসারে, ২০২২ সালে সুপার পাওয়ার আমেরিকা প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ ৩ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। এর আগে ২০২১ সালে দেশটির তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল দিনপ্রতি ১২ লাখ ৩২ হাজার ব্যারেল। যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ তেল উত্তোলন হয় টেক্সাস থেকে। এরপর উত্তোলনের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দেশটির নিউ মেক্সিকো প্রদেশ। তবে টেক্সাসের তুলনায় নিউ মেক্সিকোর তেল উত্তোলনের পরিমাণ ৪ গুণ কম।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যেমনি তেল উত্তোলনে শীর্ষে অন্যদিকে ভোক্তা চাহিদায়ও শীর্ষে অবস্থান করছে দেশটি। ২০২১ সালের তথ্যনুযায়ী, এক বছরে দেশটিতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন, যা গড়ে প্রতিদিন ২০ দশমিক ২৮ মিলিয়ন ব্যারেলের সমান।

২. সৌদি আরব

তেল উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ সৌদি আরব। ২০২২ সালে দেশটি প্রতিদিন ১ কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। বিশ্বের ১৭ শতাংশ তেলের রিজার্ভ সৌদি আরবে এবং সৌদি তেল রফতানিতে এখন পর্যন্ত তালিকার প্রথম স্থান দখল করে আছে।

সৌদির মোট জিডিপির ৫০ শতাংশ জ্বালানির ওপরে নির্ভর করে। দেশটির রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তেল বিক্রি করে। এ ছাড়া ওপেকের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সৌদি বরাবরই প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত।

৩. রাশিয়া

বিশ্বে উত্তোলনকৃত তেলের ১০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। দেশটি গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১ কোটি ৯ লাখ ৩৮ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। রাশিয়ার বেশির ভাগ তেলের খনি পশ্চিম সাইবেরিয়ার উরাল পর্বত এলাকায় অবস্থিত। যদিও ২০২২ সালের মার্চে আইইএ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়াকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত তেল উত্তোলন হ্রাস করতে বাধ্য করা হতে পারে। তবে চীন ও ভারতের বাজারে সস্তায় তেল বিক্রি করে উল্টো রাশিয়া তার জ্বালানি বাণিজ্যে নতুন রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়েছে।

৪. কানাডা

তেল উত্তোলনকারী চতুর্থ শীর্ষ দেশ উত্তর আমেরিকা মহাদেশের আরেক বৃহৎ রাষ্ট্র কানাডা। ২০২১ সালে কানাডার প্রতিদিন গড়ে তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার ব্যারেল; যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৬ লাখ ৯৪ হাজার ব্যারেল।

কানাডার বেশিরভাগ তেলের খনি আলবার্টা প্রদেশে অবস্থিত। আলবার্টার প্রাদেশিক সরকারের দেয়া তথ্যনুসারে, কানাডার মোট জ্বালানি তেলের ৯৭ শতাংশ উত্তোলন হয় এ প্রদেশ থেকে। কানাডার জ্বালানির প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে সম্প্রতি দেশটি এশিয়া মহাদেশে নিজেদের বাজার বিস্তার করার চিন্তা ভাবনা করছে।

৫. চীন

জ্বালানি তেল উত্তোলনে পঞ্চম দেশ এশিয়ার বৃহত্তর চীন। ২০২২ সালে চীনের দিন প্রতি তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৫১ লাখ ১৯ হাজার ব্যারেল। নিজেরা তেল উত্তোলন করলেও বৃহৎ ভোক্তা বাজারের চাহিদা মেটাতে দিনশেষে বড় পরিমাণের তেল আমদানি করতে হয় চীনকে।

এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে চীন। ওপেক থেকে শুধু চীনই ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত তেল আমদানি করে থাকে।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের তথ্যনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরুতে করোনা ভাইরাসের কারণে আরোপিত লকডাউনে কয়েক মাসের জন্য চীনের জ্বালানি তেল উত্তোলনের পরিমাণ কমে যায়। তবে চলতি বছর মে মাসে এসে চীন জ্বালানি তেল উত্তোলনের পরিমাণ সাড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

৬. ইরাক

অনেক ঝড় ঝাপ্টার পরেও তেল উৎপাদনে এখন পর্যন্ত ষষ্ঠ অবস্থানে আছে ইরাক। বিগত কয়েক বছরে ইরাকে জ্বালানি তেল উত্তোলন কমে এলেও ২০২২ সালে এসে কিছুটা বেড়েছে।

২০১৯ সালে ইরাকের দিনপ্রতি জ্বালানি তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৪৭ লাখ ৮৮ হাজার ব্যারেল। ২০২১ সালে উত্তোলন কমে দাঁড়ায় ৪১ লাখ ৪৯ হাজার ব্যারেলে। ২০২২ সালে ইরাকের দিনপ্রতি তেল উত্তোলনের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৫৩ হাজার ব্যারেলে।

এখন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের রিজার্ভের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ১৪৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুত আছে; যা মোট বৈশ্বিক রিজার্ভের প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ।

৭. সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)

জ্বালানি তেল উত্তোলনের হিসাবে ইউএইর অবস্থানে সপ্তমে। ওপেকভুক্ত এ দেশটি কয়েক দশক ধরে শীর্ষ দশে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।

২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ইউএই প্রতিদিন ৪৫ লাখ ১০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। দেশটির বর্তমান রিজার্ভে তেলের পরিমাণ ৯৮ বিলিয়ন ব্যারেল; যা বিশ্ব জ্বালানি রিজার্ভের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ইউএইর বেশিরভাগ তেলের রিজার্ভ আবুধাবিতে অবস্থিত।

৮. ব্রাজিল

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে একমাত্র ব্রাজিলই তেল উত্তোলনের শীর্ষ দশে অবস্থান করছে। ২০২১ সালে ব্রাজিল প্রতিদিন গড়ে ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে; যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখ ৩ হাজার ব্যারেলে।

এআইএর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ব্রাজিলের বর্তমান অর্থনীতিতে জ্বালানির ভূমিকা মুখ্য। শুধু তেল না জলবিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসেও ব্রাজিল সম্ভাবনাময় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ব্রাজিলের পেট্রোলিয়াম এজেন্সি জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ তেল উত্তোলন করা। মূলত তেল উত্তোলনে শীর্ষ পাঁচে থাকার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে দেশটি।

৯. ইরান

জ্বালানি তেল উত্তোলনে ব্রাজিলের পর নবম অবস্থানে আছে ইরান। ২০২০ সালে যেখানে দেশটির প্রতিদিনকার উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল, তা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ব্যারেলে।

২০১৭ সালে ইরানের তেল উত্তোলনের পরিমাণ ছিল দিনপ্রতি প্রায় ৪৮ লাখ ব্যারেল। ভূ-রাজনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞার বানে জর্জরিত ইরান নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তেলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রিজার্ভে মালিক মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি।
২০২১ সালে চীনের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি বাণিজ্য চুক্তি ও ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ইরানের অর্থনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

১০. কুয়েত
তেল উত্তোলনে শীর্ষ দশের শেষ দেশটি কুয়েত। ২০২১ সালে দেশটির তেল উত্তোলন কমে দাঁড়িয়েছিল দিনপ্রতি ২৭ লাখ ১৭ হাজার ব্যারেলে। ২০১৮ সালের পর এটিই ছিল কুয়েতের প্রতিদিনকার সর্বনিম্ন তেল উত্তোলন।

তবে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দেশটির উত্তোলন বেড়ে দাঁড়িয়েছে দিনপ্রতি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ব্যারেলে। কুয়েতের জিডিপির ৬০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানি থেকে। এ ছাড়া দেশটির রফতানি আয়ের ৯৫ শতাংশই জ্বালানি নির্ভর।