ঢাকা | সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪ - ১:৪৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম

যে কারণে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাচ্ছে না মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল

  • আপডেট: Saturday, February 17, 2024 - 2:22 pm
মিরসরাই প্রতিনিধি : এ.এইচ. সেলিম।। 
আমাদের কারখানাগুলো পুরোদমে চালু করা যাচ্ছে না। অপর্যাপ্ত আবাসন এবং গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতে চাচ্ছেন না।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের লক্ষ্য বেশ আকাশছোঁয়া: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ট্রানজিট হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর এবং শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে এর নৈকট্যকে কাজে লাগিয়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনা।
তবে বিশাল জনবল নিয়োগের জন্য উপযুক্ত আবাসন এবং পরিবহন সুবিধার অনুপস্থিতির কারণে দূরবর্তী অঞ্চলের শ্রমিকেরা এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাচ্ছেন।
বেপজা (বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ) অর্থনৈতিক অঞ্চলের খাইশি লিনজেরি’র কথাই ধরা যাক। গত ডিসেম্বরে আট হাজার শ্রমিক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া সত্ত্বেও তৈরি পোশাক খাতের এই চীনা কোম্পানিটি মাত্র ৮০০ কর্মী নিয়োগ দিতে পেরেছে।
মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের অংশ এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসান ও পরিবহন সুবিধা না থাকায় এখানে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।
ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে ৬০.৮৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা খাইশি লিনজেরি শ্রমিক-ঘাটতি মেটাতে জোন কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চেয়েছে।
এ সমস্যাটি খাইশি লিনজেরি এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ছাড়িয়ে গেছে। এই শিল্প নগরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের কর্মীদের আবাসন এবং পরিবহন পরিচালনার ক্ষেত্রে একই ধরনেরর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
দুই অর্থনৈতিক অঞ্চল বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) ও বেপজা-এর কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, কাছাকাছি জনবসতিপূর্ণ এলাকা না থাকায় শ্রমিক সংকট তৈরি হয়েছে এবং কারখানাগুলো পরিবহন ও আবাসন সমস্যার মুখে পড়েছে।
তবে তারা জানিয়েছেন, শ্রমিক পরিবহনের চাহিদা মেটাতে শীঘ্রই বিআরটিএ’র বাস পরিষেবা চালু করা হবে। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য আবাসন নির্মাণের একটি মহাপরিকল্পনা রয়েছে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক এনামুল  বলেন, পরিবহন সমস্যার সমাধানে গত ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিবহন কর্তৃপক্ষের [বিআরটিএ] চেয়ারম্যানের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম–ঢাকা মহাসড়কের বড়তাকিয়া থেকে শিল্পনগরীতে যাতায়াতকারী শ্রমিকদের জন্য পরিবহন সেবা শুরু হবে।’
প্রাথমিকভাবে এই পরিষেবার জন্য প্রতিটি ৪৫ আসনবিশিষ্ট পাঁচটি দ্বিতল বাস চালু করা হবে। বিআরটিএ ইতোমধ্যে বাস টার্মিনালের অবস্থান নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করছে।
আবাসন ইস্যুতে গত বছরের এপ্রিলে মিরসরাই উপজেলা উন্নয়ন পরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) প্রণয়ন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনায় মিরসরাইয়ের করেরহাট ও সাহেরখালী ইউনিয়নে ৩৬৩ একর জমিতে দুটি স্বল্পমূল্যের আবাসন প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা বলছেন, আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে তা শেষ করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। আগামী পাঁচ বছরে এ প্রকল্পের সুফল আসবে কি না বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক বলেন, ‘আমাদের চাহিদার ভিত্তিতে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর শ্রমিকদের জন্য আবাসন প্রকল্পের বিষয়টি মাস্টারপ্ল্যানে এনেছে।’ বেজা শ্রমিকদের জন্য দুটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করবে; তবে এগুলোর নকশা এবং সক্ষমতার মূল্যায়ন এখনো বাকি আছে।
খাইশি লিনজেরি-এর মানবসম্পদ কর্মকর্তা জামান উল্লা  বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলে দক্ষ ও অদক্ষ উভয় শ্রমিকেরই অভাব রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলো পুরোদমে চালু করা যাচ্ছে না। অপর্যাপ্ত আবাসন এবং গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতে চাচ্ছেন না।
খাইশি লিনজেরি বর্তমানে মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং ফেনী থেকে শ্রমিকদের পরিবহনের জন্য ৯টি গাড়ি ব্যবহার করে। প্রতিটি গাড়ির পেছনে দৈনিক খরচ গড়ে ৪৫ হাজার টাকা। এ ব্যয় কোম্পানি এবং কর্মীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়। এতে প্রভাব পড়ছে দুই পক্ষের ওপরই।
ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর চট্টগ্রাম শহর থেকে ৬৭ কিলোমিটার, ফেনী থেকে ৫০ কিলোমিটার, সীতাকুণ্ড থেকে ৩৪ কিলোমিটার এবং মিরসরাই শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
জামান উল্লাহ বলেন, শ্রমিকেরা যাতায়াতের জন্য তিন থেকে চার ঘন্টা খরচের পাশাপাশি এবং ১৫০–২০০ টাকা ব্যয় করে, যা তাদের প্রতি মাসে উপার্জনের একটি বড় অংশ।
চট্টগ্রামভিত্তিক মডার্ন সিনটেক্স সম্প্রতি শিল্প নগরে পোশাক শিল্পের কাঁচামালের জন্য একটি কারখানা নির্মাণে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ শেষ করেছে। কোম্পানিটির এক হাজার ২০০ জন কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি মাত্র ৯০০ জন অদক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে পেরেছে।
কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক শফল বড়ুয়া দক্ষ জনবল খুঁজে পাওয়ার অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘শ্রমিকদের নিয়োগের পরে ইন-হাউজ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তাদের থাকার জন্য মিরসরাই শহরে একটি ডরমেটরি স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কারখানাটিতে শ্রমিকদের নিজস্ব পরিবহনে আনা-নেওয়া করতে হয়।’
বিজিএমইএর পরিচালক এবং ক্লিফটন গ্রুপ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মহিউদ্দিন চৌধুরী চূড়ান্তভাবে প্রায় ১২ লাখ কর্মী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাজ করবে বলে অনুমান করেন।
তিনি বলেন, ‘তাই প্রায় চার লাখ শ্রমিক বসবাস করতে পারে – বেজার এমন দুটি আবাসন প্রকল্প সকলের জন্য ব্যাপকভাবে উপকারে আসবে। আমরা আশা করি বেজা শীঘ্রই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বেজা চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর সোনাগাজীতে প্রায় ৩০ হাজার একর উপকূলীয় এলাকাজুড়ে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর তৈরি করছে। অন্যদিকে বেপজা এ শিল্প নগরীর মধ্যে এক হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একরের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করছে।
বেপজা’র ৩টি এবং শিল্প নগরীর ৬টি মিলিয়ে ৯টি কারখানায় মোট এক হাজার ৫৫০ জন শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছেন। বেজা ও বেপজা’র তথ্য অনুযায়ী, আগামী তিন মাসের মধ্যে তিনটি নতুন কারখানায় অতিরিক্ত তিন হাজার শ্রমিক নিয়োগের আশা করা হচ্ছে।
পাশাপাশি বিদ্যমান কারখানাগুলোতে আরও সাত হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন। সব মিলিয়ে আগামী চার মাসে নতুন করে ১০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে।
বেপজা’র তথ্য অনুসারে, খাইশি লিনজেরি ছাড়াও চীনভিত্তিক আরও দুটি কোম্পানি — ফেংকুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল এবং কেপিএসটি শুজ — বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদনে রয়েছে। এসব কারখানায় যুক্ত আছেন প্রায় ৯৫০ জন শ্রমিক। এর মধ্যে খাইশি ৬০০, কেপিএসটি ১০০ এবং ফেংকুন ৫০ শ্রমিক নিয়োগ করেছে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের ৬টি কারখানা হলো এশিয়ান পেইন্টস, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল, নিপ্পন ম্যাকডোনাল্ড স্টিল, ম্যারিকো, সমুদা কনস্ট্রাকশন এবং বসুন্ধরা রেডিমিক্স। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। ২০২৪ সালে আরও ৩টি কারখানা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছেন কিন্তু এখনও কারখানা স্থাপন করেননি এমন কয়েকজন শিল্প মালিক টিবিএসকে বলেন, স্থানীয় শ্রমিক পাওয়া না গেলে ৬৫ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তাদেরকে শ্রমিক পরিবহন করতে হবে।
ফেনী ও নোয়াখালীর মতো দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিকদের এই আনা-নেওয়া সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হবে বলে জানান তারা।