এশিয়ার নদীগুলো দুষিত হয়ে যাচ্ছে, দায় ফ্যাশনেবল গার্মেন্টস শিল্প
মো: খায়রুল আলম খান : রাজধানীর পাশের একটি বড় শহরের প্রধান গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় নিজের বাড়ির পাশে অবস্থিত নদীর দিকে তাকিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন বয়স্ক এক ব্যাক্তি। রাজধানী ঢাকার অদূরে অবস্থিত সাভারে বসবাস করা সে বাসিন্দা আফসোসের স্বরে জানালেন, এ নদীতেই তারা ছোটবেলায় মাছ ধরতেন; ছিল নির্মল পরিবেশ। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে আজ সেই নদী ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ এবং পানির রং দাঁড়িয়েছে ঘন কালো কালির মতো।
নদীর পাশে অবস্থিত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ও ডাইং এর কারখানাগুলোই নদীটির এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। পানি দূষণ এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে নদীতে এখন কোনো মাছও নেই।
শুধুমাত্র সাভারেই নয়, বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের নদীর পানি দূষণের পেছনে প্রধান কারণ শিল্প কারখানার অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গার্মেন্ট উৎপাদন কেন্দ্র। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশে তৈরি এসব পোশাকই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানা দোকানে জায়গা করে নেয়।
কিন্তু রঙবেরংয়ের এসব কাপড় কেনার সময় ক্রেতারা কি পোশাকে ব্যবহৃত রঙ বা এর পেছনের কালো ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামান?
বাংলাদেশে শিল্প কারখানার কারণে পানি দূষণের এক-পঞ্চমাংশের জন্যই আমাদের এই ফ্যাশন শিল্প দায়ী। কারণ এখানে কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীনালা, খাল-বিলে ফেলা হয়। কঠোর আইন প্রয়োগের অভাবে এখনও নির্বিঘ্নে চলছে পানি দূষণ।
বেশিরভাগ সময় কার্সিনোজেনিক কেমিকেল, ডাই, লবণ ও অন্যান্য ভারি বস্তুর সংমিশ্রণে বর্জ্য তৈরি হয়ে থাকে যা শুধু যে পরিবেশ দূষণ করে তা নয়, একই সাথে আমাদের খাবার পানির উৎসগুলোও দূষিত করে।
বাংলাদেশের , বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা তৈরি পোশাক শিল্প ও টেক্সটাইলের মতো রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোর কারণে সংঘটিত পরিবেশ দূষণের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনকে ইমেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, “পানি দূষণ রোধের জন্য আইন প্রণয়ন ও পরিমার্জন, পানির মান পরীক্ষা, কেন্দ্রীয় ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে মিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, “পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দেশে অবৈধ উপায়ে হওয়া দূষণ মোকাবিলা সম্ভব হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের একটি আইনি কাঠামো ও নিয়মনীতি আছে।”
দেশের প্রান্তিক মানুষদের কাছে বিশুদ্ধ পানি এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয় এমন একটি ঢাকাভিত্তিক এনজিওর এক কর্তা ব্যাক্তি জানান ‘বিষাক্ত রাসায়নিক দূষণকে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো জানান, টেক্সটাইলের ডাই রঙ এবং প্রসেসিং কারখানাগুলোর বর্জ্যের কারণে ঢাকার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সবগুলো নদী ও খালের পানি ঘন এবং পিচের মতো কালো।
তাছাড়া, শীতকালে যখন বৃষ্টি হয় না এবং পানিতে থাকা বর্জ্যগুলো তরলিত করার মতো কিছু থাকে না; তখন এগুলো থেকে দুর্গন্ধ বেরোয়।
গত ১৮ বছর ধরে নিজের পরিবার নিয়ে সাভারে বসবাস করছেন ৫৫ বছর বয়সী জনৈক ব্যক্তি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, দূষিত পানির কারণে তার পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে,
তার দুই সন্তান ও নাতিরা তার সাথে থাকে না জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে থাকলে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যায়।
প্রতি বছর বিশ্ব ফ্যাশন শিল্প প্রায় ৯৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (২১ ট্রিলিয়ন গ্যালন) পানি ব্যবহার করে, যা দিয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব বলে জানিয়েছে এলেন ম্যাকআর্থুর ফাউন্ডেশন। ফিনিশিং এর কাজের পাশাপাশি ডায়িং বা কাপড়ে রঙ করাই পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে দূষণকারী প্রক্রিয়া এবং এতে শক্তিও ব্যয় হয় সবথেকে বেশি।
ফিনিশিং বলতে এমন একটি ধাপকে বোঝানো হয় যখন কাপড়ে কাঙ্ক্ষিত রূপ আনতে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয়। যেমন, ব্লিচিং, কাপড় নরম করা বা কাপড়কে পানি-নিরোধক করে তুলতে এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়। কাপড়ের রঙ ধরে রাখতে ডাইয়িং এর ধাপে প্রচুর পরিমাণ পানি এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণস্বরূপ ডেনিম জিন্সের কথা বলা যায়। একজোড়া ডেনিম জিন্স বানাতে তুলা থেকে শুরু করে জিন্স বানানো শেষ করা পর্যন্ত ৭৫০০ লিটার পানি দরকার হয়।
তাছাড়া ডেনিমের নীল রঙ ধরে রাখতে কাপড়কে ইন্ডিগো ডাইয়ের ভ্যাট রংয়ে বারবার চুবিয়ে রাখতে হয়। ডাইয়িংয়ের পর ডেনিমকে নরম করতে বা কাঙ্ক্ষিত কাপড়ে পরিণত করতে আরও বেশি রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে ধুতে হয়। রঙচটা বা পুরনো জিন্সের লুক আনতে এসিড, এনজাইম, ব্লিচ ও ফরমালডিহাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থ আরও বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে হয় ডেনিমে!
তবে শুধু জিন্স বানানোর কারণেই যে পানি দূষণ হয়, তা নয়। চীনের প্রথম সারির একজন পরিবেশবাদী মা জুন বলেন, “আমরা জানি যে প্রতি মৌসুমেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন নতুন রঙ আসে। কিন্তু যখনি নতুন কোনো রং আসবে, সেটির ব্যবহার বেড়ে যাবে এবং আপনাকে আরও বেশি ডাইয়ের সরঞ্জাম ও পিগমেন্ট এবং ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করতে হবে।”
আর একবার সেই কাজ হয়ে গেলে অব্যবহৃত বর্জ্য সোজা আশেপাশের নদী, খাল-বিলে ফেলে দেয় কারখানাগুলো।
কাপড়ে ব্যবহৃত সব রঙ অতিমাত্রায় বিষাক্ত না হলেও, টেক্সটাইল ডাইয়িং থেকে আসে এমন ৭২টি বিষাক্ত রাসায়নিকের তালিকা করেছে বিশ্ব ব্যাংক। পানিতে ফেলার পর বর্জ্যগুলো এমন অবস্থায় জড়ো হয় যে কারণে পানির নিচে আলো একেবারেই পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং পানির নিচে থাকা গাছপালা ও প্রাণীরা মারা যায়।
অন্যদিকে, রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত এই পানিই আবার জমিতে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় সাভার অঞ্চলে জন্মানো শাকসবজি এবং ফলমূলেও টেক্সটাইল ডাইয়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পানিতে মিশে যাওয়ার পর ডায়িং এর রাসায়নিক পদার্থ পানি থেকে সরানো কঠিন, তাই এগুলো পরিবেশে দীর্ঘ সময় রয়ে যায়।
ফ্যাশন শিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন ডাই রংয়ের মধ্যে আজো ডাই এবং সিনথেটিক নাইট্রোজেনভিত্তিক ডাই নিয়েই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তুলেছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ও পরিবেশবাদীরা। গাঢ় লাল বা হলুদের মতো উজ্জ্বল রংগুলোই গার্মেন্ট শিল্পে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু ডাই অ্যারোমাটিক এমাইন নিঃসরণ করে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই রংগুলো এতটাই বিষাক্ত যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন, জাপান, ভারত ও ভিয়েতনাম এগুলোর আমদানি-রপ্তানিও নিষিদ্ধ করেছে।
পোশাক রপ্তানিনির্ভর দেশগুলোতে পানি দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা। এশিয়া মহাদেশে শ্রম সস্তা হওয়ায় সেখানেই এ ধরনের সমস্যা প্রবল।
বেইজিং এর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যান্ড এনভার্নমেন্টাল এফেয়ার্স-এর মা জুন জানান, এক দশক আগেই চীনের বেশকিছু নদী ও হ্রদ এতটাই দূষিত ছিল যে সেগুলোকে মৃত নদী-হৃদ বলাই শ্রেয় এবং বর্তমানে ব্যবহারের অযোগ্য।
পানি দূষণের কারণে নদী তীরবর্তী জেলেরা জীবিকা উপার্জন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ দূষণের ফলে নদীতে মাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সাভারের আরেক বাসিন্দা জানান, নদীর দূষিত পানিতে নামলে শরীরে চুলকানি হয়। তাই এসব নদী-নালায় এখন কেউ গোসল করে না।
নানা রকম পরিবেশ দূষণের মাঝেও বাংলাদেশে পরিবর্তন আসছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এগিয়ে আসছে এবং টেক্সটাইল মালিকদের অনেকে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বকে গুরুত্ব সহকারে দেখছে। পার্টনারশিপ ফর ক্লিনার টেক্সটাইলের মতো আরও অনেক ব্র্যান্ড পরিবেশ দূষণ রোধে এগিয়ে আসছে।
পিএফআই হংকং এর অবসার বলেন, “কিছু বাংলাদেশি ফ্যাক্টরি নিজেদের মতো এগিয়ে আসছে। কিন্তু ফ্যাশন শিল্প বেশ স্বচ্ছ এবং বাজারমূল্যের প্রতি লক্ষ্যস্থির, তাই নিয়ম যারা মানছে না তাদের সরিয়ে দেওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় গুলি জানিয়েছে, পরিবেশ দূষণ হয় এমন সব কারখানার ক্ষেত্রে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন ও সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। জিরো লিকুইড ডিসচার্জ (জেডএলডি) নামের নতুন একটি বিধিমালার অধীনে টেক্সটাইল ডাইয়িং, ফিনিশিং এবং ওয়াশিং শিল্পকে অবশ্যই বর্জ্যের পরিমাণ কমানো ও বর্জ্যমিশ্রিত পানি পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা দাখিল করতে হবে।
পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, “আমাদের অবশ্যই উন্নতি সুযোগ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ রাতারাতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”
এদিকে দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছে অন্যান্য দেশও। গত কয়েক বছরে নতুন করে নানা পরিবেশ আইন জারি করেছে চীন। ২০১৭ সালে ব্যাপক ধরপাকড়ের পর দেশটিতে বহু টেক্সটাইল কারখানা বন্ধও হয়ে যায়। জিনহুয়া সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পরিবেশ সুরক্ষা ও বর্জ্য কমানোর জন্য নতুন একটি করও আরোপ করেছে তারা।