ঢাকা | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৫ - ৭:৩১ অপরাহ্ন

শিরোনাম

পার্বত্য চট্টগ্রাম: অরক্ষিত সীমান্ত ও অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট

  • আপডেট: Tuesday, December 23, 2025 - 3:44 pm

কামাল পারভেজ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ৫০৯৩ বর্গমাইল বা ১৩২৯৫ বর্গকিলোমিটার এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত জায়গায় জুড়ে গড়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল। এক কথা বলা যায়, আমাদের পার্বত্য অঞ্চল খেত অপরূপ দৃশ্যের মধ্যে সেখানে কী নেই—স্রষ্টার অপরিসীম কল্পনার শক্তিতে অজস্র সম্পদ এবং বাংলাদেশ নামক মানুষের জীবন চাহিদার ৬০% জোগানদাতা হিসাবে উৎপাদন হয় এই পার্বত্য অঞ্চলে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট সীমান্ত সড়ক ১,০৩৬ কিলোমিটার বলছে, কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় সীমান্ত সড়ক ৭৩৫ কিলোমিটার। সরকারের সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ প্রকল্পের কাজ কয়েকটি পর্যায়ে চলমান রয়েছে, তার মধ্যে ৩১৭ কিলোমিটার প্রথম পর্যায়ে কাজ চলছে। ওই সড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল একটা অভিন্নতায় রূপ ধারণ করে আসছে এবং রাজনৈতিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বাংলাদেশ দেখালেও, সার্বিকভাবে ‘বন্ধু’ শব্দটা তারা হিংসাত্মকভাবে দেখেন। যেহেতু ভারতের বিগত একশত বছরের পূর্ব-পরিকল্পনা—অখণ্ড ভারত—ভাগ বিশেষ বাংলাদেশকে গিলে ফেলতে পারেনি এবং অখণ্ড-ভারত মানচিত্র থেকে ছিটকে পড়েছে, সেই মাকড়শার জাল বুনতেই তারা সহজে পিছুপা হবেন না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাঙালিয়ানা বাংলাদেশের অংশবিশেষ বলে ইতিহাসের মানচিত্র থেকে দেশ স্বাধীনতার পর দেশ ভাগের নামে সুকৌশলে বাঙালিয়ানা দুই ভাগে বিভক্ত করে পশ্চিমবঙ্গের নতুন মানচিত্র ভারতের লিপিবদ্ধ করে নিয়ে গেছে; বাংলাদেশের অনেক সম্পত্তি ভারতের মানচিত্রে অংশবিশেষ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ঘেঁষে ভারতের সীমানা, দক্ষিণ-পূর্বে নাফ নদী ঘেঁষে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার জুড়ে মিয়ানমারের সীমানা অবস্থিত বললেও গবেষণায় দেখা যায় ১৭০ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ ঘেঁষে রাখাইন রাজ্য। একটি তৃমুখী পয়েন্ট রয়েছে—বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলা, বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের ধোপানিছড়ি পাড়া সীমান্ত ঘেষে মিজোরাম ও মিয়ানমার সীমান্ত (শূন্য রেখা বলা হয় এবং ইংরেজিতে Tri Junction)। উপজেলা সদর থেকে এই দুর্গম এলাকায় বড়থলি ইউনিয়নে যেতে হলে নৌকা/ইঞ্জিন চালিত নৌকায় অথবা পাহাড় দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। এছাড়া বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার মাধ্যমে হেঁটে বড়থলি ইউনিয়নে আসা যায়।

মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ ও ভারত, উত্তর-পূর্বে চীন, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে লাওস ও থাইল্যান্ড, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। তবে উত্তর আরাকান (রাখাইন রাজ্য) শেষ সীমান্ত ও ভারতের দক্ষিণ সীমান্ত এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত হচ্ছে তৃমুখী পয়েন্ট। ভারতের একটি প্রদেশকে ‘সেভেন সিস্টার’ বলা হয়, অর্থাৎ ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি রাজ্য—নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও অরুণাচল—এই অঞ্চলে অবস্থিত।
এই তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিষয়ের পিছনে একটু তাকানো যায়। যেমন, ১৯৩৭ সালে যখন এই বিশাল কলোনি বা উপনিবেশ ব্রিটিশ মিয়ানমার ও ব্রিটিশ ভারতে বিভক্ত হয়, তখন এই সীমান্ত আধা-আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান এবং ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার ছেড়ে যায় ব্রিটিশরা। তখন সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ পাকিস্তান শাসিত হয়ে পড়লে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হয়। এর ফলে মিয়ানমার-পাকিস্তান সীমান্ত মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে পরিণত হয়। তবে ওই সময়ের পূর্বে দৃশ্যপট ভিন্ন ছিল; মিয়ানমার ও বাংলাদেশ পূর্বে একটি রাষ্ট্র দ্বারা শাসিত হতো—ব্রিটিশ ভারত। আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে পৃথককারী লাইন তুলনামূলকভাবে নতুন।

উপরের বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমার সম্পর্কিত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি হওয়ার আগে পার্বত্য গেরিলা শান্তি বাহিনী নামক সশস্ত্র গ্রুপ ছিল। তখনকার সময়ে উগ্রবাদী শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র ও অর্থ যোগানদাতা হিসেবে ভারত পরিচালনা করতো। শান্তিচুক্তির পর দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করলে কয়েক বছরের মধ্যে শিক্ষিত উপজাতি যুবকরাও তাদের স্ব-স্ব আধিপত্য বিস্তারের জন্য পাহাড়ে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে।

বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রধারী সশস্ত্র গ্রুপ প্রায় ৭টির মত রয়েছে—পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ-গণতন্ত্র, এমএল, জেএল, ত্রিপুরা ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও কেএনএফ। এই সব সশস্ত্র গ্রুপের প্রধানদের আন্তর্জাতিক অপরাধ নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই ৭টি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে শক্তিশালী ৩টি হলো—পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় একেকটি জোন ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। এসব অস্ত্র বাংলাদেশে তৈরি করা তো দূরের কথা, স্বপ্নেও তারা দেখেনি। এই সশস্ত্র গ্রুপের প্রধান শিক্ষিত উপজাতি যুবকদের মাথা-মগজ ধোলাই করছে ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক ইউনিসেফ এনজিও। এসব দেশের একটাই লক্ষ্য—বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং কেউ বৌদ্ধ রাষ্ট্র, কেউ খ্রিস্টান রাষ্ট্র বা আবার কেউ নিজ দেশের মানচিত্রের অংশবিশেষ হিসেবে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য অস্ত্র ব্যবসা সুকৌশলে চালানো হচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে যেসব অস্ত্র রয়েছে—ল্যান্ড মাইন, এন্টি-ট্যাংক, মোটরসেল ও মেশিনগান—তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গ্রুপের কাছে মেশিনগান, মটরসেল, ল্যান্ডমাইন, এন্ট্রি টাইম অস্ত্র পাওয়া যায়। ভারতীয় অস্ত্র যেমন ভুজ, মুঘল ও মুগদার আধুনিকায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়।
চীন থেকে আনা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে: কিউবিইউ-৮৮, স্নাইপার রাইফেল, অ্যাসল্ট রাইফেল, লাইট মেশিনগান, QBZ-৯৫, QBZ-১৯১, জেনারেল পারপাস মেশিনগান, মাল্টিপারপাস মেশিনগান, ১২.৭ এমএম ভারী এয়ার ডিফেন্স মেশিনগান। থাইল্যান্ড থেকে সরবরাহকৃত অস্ত্র: SIG Sauer P226, ডেউ ইউএসএএস-১২, উজি, এফএন পি৯০, কোল্ট এম৫, IWI Tavor X95, আইএমআই গ্যালটজ (স্নাইপার), ব্যারেট এম৮২/ব্যারেট এম১০৭, এম২-৪৯। এসব অস্ত্র মূলত থাই সেনাবাহিনী ব্যবহার করে।

এগুলো এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের অবৈধ উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনের হাতে। এই অস্ত্র যেভাবে মিয়ানমার ও ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয় এবং অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা, নফনদী হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, রোয়াংছড়ি ও রুমা দিয়ে রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা বড়থলি ইউনিয়ন পাড়া, যেখানে তৃমুখী পিলার সীমান্ত (মিয়ানমারের শেষ সীমানা) অবস্থিত।

ভারতের সেভেন সিস্টার, মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে শুরু এই পথ কুকী চীন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএফ)-এর অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট। রাঙামাটি জেলার সাথে বিলাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সীমান্ত, তার মধ্যে বরকল উপজেলার বড়হরিণা, তবলাবাগ ও থেগামুখ অঞ্চল বড় অস্ত্র চোরাচালান ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে খ্যাত। বাঘাইছড়ি উপজেলার আর্যপাড়া, মাঝিপাড়া ও সাজেক ইউনিয়নসহ এই ট্রানজিট পয়েন্টগুলো বিপদজনক ব্লক হিসেবে পরিচিত।

বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে শুরু হয়ে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙা, তবলছড়ির তানাক্কা পাড়া ও রামগড় উপজেলা পর্যন্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা রয়েছে। দীঘিনালা সীমান্তে তৈদুছড়া, মায়ফা পাড়া, নয় মাইল, পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের গ্রামগুলো রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হলো কালারাম পাড়া, লাল মোহন পাড়া, শোভাচন্দ্র পাড়া। এছাড়াও ইউনিয়নটিতে আরও গ্রাম রয়েছে যেমন ঘিলাতুলি পাড়া। চেঙ্গী ইউনিয়নের তারাবন গির্জা পাড়া ও সীমানা পাড়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যার নাম শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠে—দুদকছড়া।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ৭৩৫ কিলোমিটার সীমানা জুড়ে ভারতের সীমান্ত পুরোপুরি বিপদজনক বলা চলে। নির্দিষ্টভাবে সীমানা রক্ষিত নেই, তাই অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়। অরক্ষিত অবস্থায় সীমান্তের কাছাকাছি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পাহাড়াদার অবস্থায় কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও কম্বোডিয়া থেকে আসা অস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপের হাতে আসে, যা শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নয়; চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় সন্ত্রাসীদের হাতেও চলে যায়। চট্টগ্রামে এসব অস্ত্রের আদান-প্রদানের ট্রানজিট পয়েন্টগুলো হলো—নাইক্ষ্যংছড়ি রামু উপজেলা, লামা উপজেলা ফাইতং চকরিয়া রোড, বোয়ালখালী উপজেলা আহালিয়া দরবার শরীফের উত্তর প্রান্তের রোড, রাজস্থলী উপজেলা বাঙালখালী হয়ে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া রোড, কাউখালী উপজেলা বেতবুনিয়া পশ্চিম সোনাইছড়ি রোড, লক্ষীছড়ি উপজেলা ও ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চনা গ্রামের রোড এবং ভুজপুর-রামগড় চা বাগান।
সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তগুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষা করা এবং সিকিউরিটি ফোর্স বাড়িয়ে প্রতি আধা কিলোমিটার অন্তর চেকপোস্ট বসানো। নচেৎ ভবিষ্যতে অস্ত্র চোরাচালান দমন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।