ঢাকা | ডিসেম্বর ১০, ২০২৫ - ১২:৩৫ অপরাহ্ন

শিরোনাম

খেজুরের রস ও গুড়: হারিয়ে যাওয়ার পথে এক জনজীবন ও ঐতিহ্য

  • আপডেট: Wednesday, December 10, 2025 - 10:47 am
মো. মামুন হাসান।। শীতের ভোরে গ্রাম তার নিস্তব্ধতা ধরে রাখে। কুয়াশার পাতলা ঢেউ আঙিনার মাটিতে ভেসে আসে, সূর্যের প্রথম রশ্মি পাতার ফাঁকফোকরে ঢুকে প্রতিটি কোণকে আলোকিত করে। আঙিনায় যেন নতুন দিনের প্রথম নিঃশ্বাস স্পন্দিত হচ্ছে। খেজুরের গাছগুলো থেকে ঝরে পড়া সোনালি রস মাটির পাত্রে জমে এক অদ্ভুত মাধুর্য সৃষ্টি করছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন গ্রামের জীবনের ছোট্ট গল্প, যা নিঃশব্দ সকালকে জীবন্ত করে তোলে। শিশুর দৌড়ঝাপ, পাত্র হাতে লাফিয়ে ওঠা হাসি, বৃদ্ধদের ধীর ধীর রস সংগ্রহ সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবনের এক উৎসবের প্রতিফলন তৈরি করছে।

চুলায় আগুন জ্বালিয়ে রস থেকে গুড় তৈরি করা হচ্ছে। সেই ঘ্রাণ বাতাসে মিশে ঘরবাড়ি জুড়ে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শীতের হাওয়ায় ভেসে আসা সুগন্ধ শিশুদের মুখে মিষ্টি রসের আনন্দের ছোঁয়া এনে দিচ্ছে। প্রতিবেশীরা একে অপরের ঘরে গুড় ও পিঠা নিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এই দৃশ্য গ্রামের শীতের অমলিন স্মৃতিকে জীবন্ত করে, যেখানে সুগন্ধ, হাসি ও মধুরতা একসাথে মিশে মানুষের মনে উষ্ণতা জাগায়।

কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, কৃষিকে অগ্রাহ্যতা এবং রস সংগ্রহের অনিয়মের কারণে খেজুরের রস ও গুড়ের উৎপাদন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে গ্রামীণ স্বাদ, সরল জীবনধারা এবং শতবর্ষের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। খেজুরের রস ও গুড় সংরক্ষণের জন্য এখনই প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ। গাছীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, যত্ন, সঠিক রস সংগ্রহ পদ্ধতি এবং নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করা অপরিহার্য। গুড়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করলে চাষীরা লাভবান হবেন এবং গাছ কেটে ফেলার প্রবণতাও কমবে।

সরকারি উদ্যোগে খালি জমিতে নতুন গাছ রোপণ, রাস্তার ধারে গাছ লাগানো, রোগবালাই প্রতিরোধ এবং আধুনিক চাষাবাদের পদ্ধতি প্রয়োগ করলে গাছ সুস্থ, ফলদায়ী ও দীর্ঘজীবী হবে। খেজুরের রস ও গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি হলে শুধু খাদ্য সামগ্রী নয়, গ্রামীণ অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সংস্কৃতিও উপকৃত হবে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়লে গ্রামের চাষীরাও লাভবান হবেন এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী হবে।

খেজুরের রস ও গুড় কেবল খাদ্য নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের পরিচয়ের এক অমূল্য চিহ্ন। প্রতিটি ফোঁটায় লুকিয়ে আছে গ্রামীণ জীবনের গল্প, শ্রমের আনন্দ এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিখুঁত সম্পর্ক। সচেতনতা, পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের মাধ্যমে এই হারানো স্বাদ ও ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব।

আজই সময় খেজুরের রস ও গুড়কে নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করার। এটি বাঁচালে আমরা বাঁচাতে পারব শুধু স্বাদ নয়, বাঁচাতে পারব গ্রামীণ জীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ। শীতের সকালে পিঠাপুলি, আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা খেজুরের ঘ্রাণ এবং গ্রামের প্রাণবন্ত দৃশ্য যেন কখনও হারিয়ে না যায়।

  • লেখক- ইনস্ট্রাক্টর (টেক) ও বিভাগীয় প্রধান
  • ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
  • সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।