ঢাকায় এইডস সংক্রামন হার বেশি
জাগো জনতা অনলাইন।। এইচআইভি এইডস মরণব্যাধি রোগ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এইচআইভি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক দেশে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মরণব্যাধি এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও বাড়ছে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা।
দেশের সিরাজগঞ্জ ও বরিশালে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। সিরাজগঞ্জে ৫ বছরে ২৫৫ রোগী শনাক্ত, মারা গেছে ২৬ জন। তবে এখনই ‘রেড জোন’ বিবেচনা করা হচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বরিশালেও ২০ জন এইচআইভি পজিটিভ। একই সিরিঞ্জে মাদক গ্রহণ, রোগের তথ্য গোপন, সচেতনতার অভাব ও অনিরাপদ যৌন সম্পর্ককে দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা।
সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের এআরটি সেন্টারের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ২৫৫ জন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের ২২৬ জন, বাকিরা অন্য জেলার। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৬ রোগী।
এদিকে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বরিশালেও গত এক বছরে ২০ জন এইচআইভি পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে ১১ জনই শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে এক বছরে নতুন রোগী বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। এসব রোগীর প্রায় অর্ধেকই পুরুষ সমকামী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছর সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা জেলায়। এ জেলায় নতুন রোগী পাওয়া গেছে ৩৩৪ জন। এরপর কুমিল্লা জেলায় ১০৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম ও খুলনায় প্রায় ১০০ জন করে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিভাগ হিসাবে চলতি বছর রাজশাহী বিভাগে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে সিরাজগঞ্জ জেলায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সমকামীরা সমাজে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কে কার হাত ধরে এই জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তা জানা না গেলেও তাদের মাধ্যমে যে সুস্থরা আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই ইঙ্গিত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম বলছে, দেশে ২০১৫ সালে পুরুষ সমকামীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার হয়েছে। দেশে শনাক্ত হওয়া রোগীদের সর্বশেষ তথ্য উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে মোট শনাক্ত রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশই পুরুষ সমকামী হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। আজ বিশ্ব এইডস দিবস। এ দিবস সামনে রেখে এইডস রোগীদের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন স্পর্শকাতর তথ্য।
পুরুষ সমকামী কেন বাড়ছে, এর ব্যাখ্যা তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের ম্যানেজার (ডেটা অ্যান্ড আইটি) মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী। তিনি বলেন, সন্দেহভাজন রোগীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়া, সমাজে রোগটির ভীতি, অপবাদ কমা এবং সরকারি-বেসরকারিভাবে এইডস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কর্মসূচি বাড়ছে। দিন শেষে টেস্ট ও স্ক্রিনিং বাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। যার মধ্যে সমকামী পুরুষ শনাক্ত বেশি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (টিবিএল অ্যান্ড এএসপি) তথ্যে জানা যায়, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন আনুমানিক ২ হাজার জন। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩৮ জন। এ সময়ে এইডসে মারা গেছেন ২০০ জন, যা আগের বছরের ১৯৫ জনের চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নতুন শনাক্ত রোগীদের মধ্যে সমকামী পুরুষের আচরণ ঝুঁকিপূর্ণ। তারা সমাজের নীরব ঘাতক। রোগটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা উদ্বেগজনক।
এইডস রোগীদের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে আরও জানানো হয়, বিভাগ ও জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। রাজধানীর ঘনবসতি, অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এবং উচ্চঝুঁকির জনগোষ্ঠীর একাংশের নিয়মিত চিকিৎসার আওতায় না আসাকে বিশেষজ্ঞরা রোগ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছেন। এমন বাস্তবতায় আজ ১ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস ২০২৫। জাতিসংঘের ইউএন এইডস ঘোষিত এবারের প্রতিপাদ্য হলো-‘সব বাধা দূর করি, এইডসমুক্ত সমাজ গড়ি’।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি শনাক্ত হওয়ার ৩৫ বছর পর এবারই এক বছরে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী এসডিজির এইচআইভিবিষয়ক ৩.৩-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৯৫-৯৫-৯৫ লক্ষ্য অর্জন করার শর্ত রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ সম্ভাব্য এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার কথা। ৯৫ শতাংশ সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং ৯৫ শতাংশ চিকিৎসা গ্রহণকারীর ভাইরাল লোড নিয়ন্ত্রিত রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটা উলটো।
দেশে শনাক্ত মোট এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৬৩ জনের মধ্যে ২ হাজার ২৮১ জন মারা গেছেন। চিকিৎসা নিচ্ছেন ৮ হাজার ৩০৯ জন রোগী।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এইচআইভি সন্দেহে ২ হাজার ৪৮৬ জনের পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ১৮৪ জনের এইচআইভি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ১৪১, নারী ৩৮, হিজড়া ৪ জন এবং সমকামী পুরুষ ৭১ জন ছিলেন।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, সংক্রমিতদের মধ্যে ১০৭ জন বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। মা-বাবার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন ১০ জন। প্রবাস থেকে সংক্রমণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৪২ জন। একই সময়ে হাসপাতালে এইডস সম্পর্কিত জটিলতায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়; তাদের মধ্যে ৭ জন চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মারা যান। পরবর্তী সময়ে, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে ২ হাজার ১৯২ জনের পরীক্ষা করা হয়। এ সময়ে ২৭৩ জনের শরীরে এইচআইভি সংক্রমণ ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে পুরুষ ২১৫, নারী ৫৭ এবং হিজড়া ১ জন।
ওই হাসপাতালের তথ্যে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সংক্রমিতদের মধ্যে পুরুষ সমকামী ৭৮ জন, পুরুষ যৌনকর্মী ৩৯ জন এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি রোগী হিসাবে শনাক্ত হয়েছেন ১৩৮ জন। একই সময়ে হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৫ জন রোগী।
চিকিৎসকরা জানান, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সম্প্রতি যেসব নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বয়সে তরুণ। যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। পাশাপাশি বিদেশফেরত শ্রমিক এবং পুরুষে পুরুষে যৌন সম্পর্কে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে যুক্ত কিছু ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার। তিনি বলেন, এইচআইভি রোগীরা নিয়মিত বিনামূল্যে ওষুধ পেলেও জটিল রোগীদের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এমআরআই, বায়োপসি, সিডি-৪ কাউন্টের মতো পরীক্ষার সুবিধা এখানে নেই। ফলে রোগীদের এসব পরীক্ষা বাইরের প্রতিষ্ঠানে করাতে হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাল ও প্যারাসাইটিক সংক্রমণ দেখা গেলেও সেগুলো নির্ণয়ের উন্নত ব্যবস্থা নেই। নেই ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থাও। জনবল সংকটের কারণে জটিল রোগীর লাইফ সাপোর্ট প্রদানেও সমস্যা হয়। পাশাপাশি উন্নতমানের অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহও সীমিত।
হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. এআরএম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোগীচিত্র বদলাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে প্রবাসফেরত পুরুষ শ্রমিক এবং বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষ রয়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পরিবর্তন বা সচেতনতার অভাবই তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। হাসপাতালের তথ্যমতে, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রায় অর্ধেকই বিদেশফেরত শ্রমিক। উল্লেখযোগ্য অংশ আবার ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ।











