ঢাকা | নভেম্বর ২৬, ২০২৫ - ৮:৫৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

বান্দরবানে জেলা পরিষদের চারা বিতরণের প্রকল্পের কোটি টাকা লুটপাট

  • আপডেট: Wednesday, November 26, 2025 - 7:26 pm

নিজস্ব প্রতিবেদক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে কৃষক ও নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ৩ কোটি টাকার ফলদ ও বনজ চারা বিতরণ প্রকল্প হাতে নেয় বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু দরপত্র আহ্বান ছাড়াই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় বান্দরবান জেলা হর্টিকালচার উইংকে। মাঠপর্যায়ের এই বিপুল পরিমাণ বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ কাগজে-কলমে হিসাব ঠিক রেখে লোপাটের অভিযোগ উঠেছে বান্দরবান জেলা হলটিকালচার উইং এর উপপরিচালক লিটন দেবনাথ, জেলা পরিষদের সদস্য ও কৃষির কনভেনার লালজার লং বম ও পরিষদের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী লেলিন চাকমার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বে থাকা বান্দরবান হলটিকালচার উইংয়ের উপপরিচালক লিটন দেবনাথ সরাসরি এই অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও কৃষি সম্প্রসারণ, হলটিকালচার উইং-এর আহ্বায়ক রেভা. লালজার লম বম এবং জেলা পরিষদের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী লেলিন চাকমার বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও, এই প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অনিয়মটি ঘটেছে চারা ক্রয়কে কেন্দ্র করে। দরপত্র আহ্বান ছাড়াই ডিফিএম টেন্ডার দেখিয়ে ৫ লাখের বেশি চারা কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সরাসরি বান্দরবান জেলা হর্টিকালচার উইংকে যার নেতৃত্বে ছিলেন উপপরিচালক লিটন দেবনাথ। অনুসন্ধানে জানা যায়, হর্টিকালচারের নিজস্ব নার্সারিতে এত চারা ছিলই না। এ সুযোগে তিনি বাইরে থেকে খুব কম দামে অপরিণত চারা কিনে এনে সরকারি নথিতে তার দাম কয়েকগুণ বেশি দেখান। ফলে প্রকল্পে তিনি কার্যত নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়েন। সরকারি চাকরিতে থেকে কোনো কর্মকর্তা ঠিকাদারি করতে পারেন না, কিন্তু লিটন দেবনাথ নিজের দফতরের ঘাটতিকে আড়াল করে উচ্চমূল্যের চারা সরবরাহের নাম করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন।

জানা যায়, প্রকল্পে প্রায় ৩ কোটি টাকার স্কীমে সমগ্র জেলায় সাতটি উপজেলায় মোট ২১ শতাধিক কৃষক ও নারী উপকারভোগীর মধ্যে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৩ শত ফলদ, বনজ, বাঁশ ও কফির চারা বিতরণের কথা। অনেক স্থানে কৃষকদের হাতে মাত্র কয়েকটি চারা ধরিয়ে ছবি তোলার কাজ সর্ম্পন করেন, যাতে কাগজে বিতরণের প্রমাণ দেখানো যায়। এছাড়া প্রতিকৃষককে ইউরিয়া সার ৪.৭৬ কেজি, টিএসসি সার ৬.৬৭ কেজি, এমওপি সার ৫ কেজি, জৈব সার ২৩.৭৯ কেজি এবং কীটনাশক ২ বোতল (২০০ মি.লি) দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ কৃষক জানিয়েছেন, তারা এসব কিছুই পাননি। বান্দরবানের রোয়াংছড়ির এক কৃষক বলেন, তালিকায় নাম আছে, কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। তারা কয়েক জনকে কিছু চারা দিয়ে শুধু ছবি তুলেছে, পরে আর দেখা নেই। এছাড়া যা চারা ছিলো তা খুবই ছোট ছিলো যার করণে অনেকে চারা না নিয়ে চলে গেছে। অন্যদিকে থানচি উপজেলার আরেক কৃষক বলেন, কোন প্রশিক্ষণ নাই সার দেওয়ার কথা ছিল তাও দে নাই আমরা এতো ছোট চারা দিয়ে কী করবো? আর যে চারা দিয়েছিলো, কয়েকদিন পরই তা শুকিয়ে মরে যায়।

নথি অনুযায়ী, ফলদ চারা ১১৯টি, বনজ চারা ১২৩টি, বাঁশের চারা ৬৩টি এবং কফির চারা ৪৮টি প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকই জানেন না, এই চারাগুলো কোথায় বিতরণ হয়েছে। সার ও কীটনাশক বিতরণেও একই চিত্র: ইউরিয়া ৪.৭৬ কেজি, টিএসপি ৬.৬৭ কেজি, এমওপি ৫ কেজি, জৈব সার ২৩.৭৯ কেজি ও দুটি কীটনাশকের বোতল (২০০ মি.লি.) দেওয়ার কথা থাকলেও বেশীরভাগ কৃষকও এসব সরঞ্জাম পাননি।

বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় চারা বিতরণের নাম করে স্থানীয় কৃষকদের হাতে নষ্ট ও অযোগ্য চারা তুলে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ কৃষক জানেন না কীভাবে চারা রোপণ বা পরিচর্যা করতে হয়। থানচির এক কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদিন জেলা পরিষদের কিছু লোক এসে হাতে কয়েকটি চারা ধরিয়ে ছবি তুলে চলে যায়। এরপর আর কেউ খবর নেয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই সব চারা শুকিয়ে যায়। রোয়াংছড়ির এক নারী কৃষক জানান, যদি প্রশিক্ষণ দিত, তাহলে হয়তো চারা বাঁচাতে পারতাম। এখন সব নষ্ট হয়ে গেছে, শুধু সরকারি টাকা নষ্ট হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এমন প্রকল্পের দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাতে থাকা উচিত ছিল। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল আছে, মাঠে কাজের অভিজ্ঞতাও আছে। হলটিকালচার উইংয়ের হাতে দিয়ে প্রকল্পটি পানিতে ফেলা হয়েছে।
বান্দরবান জেলা পরিষদের এক কর্মকর্তা জানান, সব দায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এড়াতে পারবেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থাকতেই কেন হলটিকালচার উইংকে দেওয়া হলো, সেটি বড় প্রশ্ন। প্রকল্পের বাজেট ছিল ৩ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ১ কোটি টাকার মতো চারা কেনা হয়েছে। বাকী অর্থ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। বান্দরবান শহরের সচেতন নাগরিকরা প্রকল্পের অনিয়মে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেন দ্রুত তদন্ত শুরু করে।

বান্দরবান পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমান প্রকল্পের দুর্নীতির ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত অর্থ উন্নয়নের বদলে এখন দুর্নীতির জালে আটকে যাচ্ছে। পাহাড়ের কৃষক আজও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে, অথচ কাগজে-কলমে কোটি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। দুদককে দ্রুত তদন্তে নামতে হবে। সঠিকভাবে তদন্ত হলে এই লুটপাটে বড় বড় কর্মকর্তাদের নাম বেরিয়ে আসবে।

একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আরও কঠোর ভাষায় বলেন, প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতি এখন পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হচ্ছে। তদন্তে গেলে দেখা যাবে, একটি চক্র নিয়মিতভাবে সরকারি অর্থ লুট করছে, আর প্রশাসনের ভেতরের কিছু ব্যক্তি এই নেটওয়ার্ককে সুরক্ষা দিচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে জেলা পরিষদের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী লেলিন চাকমার কাছে জানতে চাইলে তিনি সংক্ষিপ্ত জবাবে বলেন, কোনো কাজ শতভাগ করা যায় না। এরপর তিনি তড়িঘড়ি করে ‘মিটিং আছে’ বলে আলাপ শেষ করে সরে যান।

হর্টিকালচার উইংয়ের অভিযুক্ত উপপরিচালক লিটন দেবনাথ বলেন, বিষয়টি নিয়ে বসে আলোচনা করলে সমাধান করা যাবে। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেননি বা সরাসরি কোনো ব্যাখ্যাও দেননি।

অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ উইংয়ের আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদের সদস্য লালজার লং বমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাননি।

বিষয়টি নিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি সরাসরি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং কোনো বক্তব্য না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।