ঢাকা | নভেম্বর ১৯, ২০২৫ - ৯:৪৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম

মাসুদ আর ভালো হলো না; লামায় জমি জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ

  • আপডেট: Wednesday, November 19, 2025 - 7:01 pm

বিশেষ প্রতিবেদক।

মাসুদ আর ভালো হলো না, অবশেষে লামায় জমি জালিয়াতির এক চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে দৈনিক জাগো জনতার হাতে। বান্দরবানের লামা উপজেলায় জমি ক্রয়ের নামে সুপরিকল্পিত প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল অনেক আগেই। অভিযোগ অনুযায়ী, খুলনা জেলার মাসুদ পারভেজ ভুয়া পরিচয়, ও মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে নিজেকে লামার স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে জমির বায়না দলিল সম্পাদন করেন। ঘটনাটি প্রথমে ব্যক্তিগত লেনদেন মনে হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও বিস্ময়কর তথ্য, এই জালিয়াতিকে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান।লামা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এমন প্রতারণা সম্ভব ছিল না বলেই স্থানীয়দের অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জমির বায়না নামা দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় মাসুদ পারভেজ তাঁর পিতা হিসেবে মো. ইউনুস আলী একটি জবানবন্দি জমা দেন। কিন্তু দৈনিক জাগো জনতা সেই জবানবন্দির সূত্র ধরে মো. ইউনুস আলীর হুকুমনামা রেকর্ড উত্তোলন করলে দেখা যায়, রেকর্ডে তাঁর কোনো ছেলের তালিকায় মাসুদ পারভেজ নামে কেউ নেই। ফলে জমির বায়না নামা দলিল রেজিষ্ট্রেশনের সময় পিতা উল্লেখ করে যে জবানবন্দি দিয়েছিলো তা ভুয়া। একই সঙ্গে আরেকটি গুরুতর অসঙ্গতি সামনে আসে পিতার বংশপরিচয়ে। হুকুমনামা রেকর্ডে দেখা যায়, মো. ইউনুস আলীর পিতার নাম ইদু শেখ। কিন্তু মাসুদ পারভেজ প্রকৃত দাদার নাম এহেসান উদ্দিন শেখ। এছাড়া স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয় দেখানোর জন্য মাসুদ পারভেজ একটি রাজার সনদ (চিপ সার্কেল সনদ) দাখিল করেছিলেন। তবে চিপ সার্কেল অফিস জানায়, ১৭৮৩০ নম্বরের ওই সনদ তাদের রেকর্ডে নেই এবং মাসুদ পারভেজ নামে কাউকে কোনো রাজার সনদ ইস্যু করা হয়নি। ফলে তাঁর স্থানীয় পরিচয় প্রমাণের নথিটিও জাল বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরিচয় যাচাইয়ের জন্য দাখিল করা ইউনিয়ন পরিষদের জাতীয়তা সনদটিও সঠিক নয় বলে জানা গেছে। সরই ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই সনদ তাদের জারি করা নয় এবং তাদের রেকর্ডের সঙ্গে সনদের কোনো তথ্য মেলে না।

ঘটনাটি নিয়ে লিখিত অভিযোগে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন উল্লেখ করেন বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। অভিযোগে তিনি বলেন, উপজেলার ৩০৬ নম্বর ফাইতং মৌজার ৬৩৬ নম্বর হোল্ডিং-এর অধীন জমি ক্রয়ের সময় খুলনা জেলার মো: ইউনুস আলীর ছেলে মো. মাসুদ পারভেজ প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমির বায়না দলিল সম্পাদন করেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে উক্ত জমির বায়না নামা দলিল নং ১১৮/২০২২ সম্পাদনের সময় মো. মাসুদ পারভেজ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের প্রকৃত পিতা-মাতার নাম গোপন করে অন্য একজনকে পিতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। এছাড়া তিনি ভুয়া জাতীয়তা সনদ, জাল স্থায়ী বাসিন্দা সনদ ও জাল দলিলপত্র ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট জমির দলিল সম্পাদন করেন। আমি প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে বায়না দলিলটি বাতিল ও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ও সংবেদনশীল- এ বিষয়ে স্পষ্ট আইন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন কোনো ব্যক্তি এই অঞ্চলে জমির মালিকানা বা ক্রয়-বিক্রয়ে অংশ নিতে পারে না। অর্থাৎ পার্বত্য এলাকার বাহিরে কোন ব্যক্তির পার্বত্য এলাকায় জমি ক্রয়ের কোনো আইনগত সুযোগই নেই। অতএব, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে জাল জাতীয়তা সনদ, ভুয়া স্থায়ী বাসিন্দা সনদ, মিথ্যা ঠিকানা বা সংশোধিত আইডি কার্ড ব্যবহার করে নিজেকে পার্বত্য এলাকার নাগরিক হিসেবে উপস্থাপন করে জমি ক্রয় করেন, তাহলে এটি শুধু প্রতারণা নয়, বরং বাংলাদেশের আইনে গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ।

তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রতারণা সংঘটনের ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে, তবে দুদক আইন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সিডিউল অনুযায়ী সেই সহযোগীরাও দুর্নীতি ও অপরাধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। যার ফলে অপরাধী ব্যক্তি ছাড়াও সহযোগী বা সুবিধাভোগীরাও আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে।

তিনি মনে করিয়ে দেন, জাল দলিল তৈরি, ভুয়া সনদ ব্যবহার, পরিচয় গোপন বা মিথ্যা তথ্য প্রদান, সবই বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দলিল বাতিল, হস্তান্তর স্থগিত এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে।

স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এ ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতারণা নয়, বরং প্রশাসনিক যাচাই-বাছাই ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও স্পষ্ট করে তুলেছে। তাদের মতে, যদি বহিরাগতরা সহজে ভুয়া পরিচয়ে পার্বত্য অঞ্চলে জমি কিনতে পারে, তবে ভবিষ্যতে এর মারাত্মক সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রভাব পড়বে।

এদিকে, স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লামা কোয়ামন্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্টান এই ঘটনার পরও অভিযুক্ত মাসুদ পারভেজকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সংস্থাটি বিষয়টি জানার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে “সেল্টার” দিয়েছে। এতে করে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, একজন বহিরাগত ব্যক্তি ভুয়া পরিচয়ে জমি ক্রয়ের পরও কেন একটি প্রতিষ্টান তাকে আশ্রয় দিচ্ছে?

লামা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মঈন উদ্দিন বলেন, অভিযোগটি আমরা পেয়েছি। তারপরেই ওনাকে নোটিশ দিয়েছি, সে সময়ের আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। দলিলের সত্যতা, নাগরিক পরিচয় ও সকল কাগজ পত্র যাচাইয়ের কাজ চলছে।

আইন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের প্রতারণা শুধু ব্যক্তি নয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই সুষ্ঠু তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই ঘটনার দায় নির্ধারণ করা জরুরি।

স্থানীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম বলেন, খুলনা জেলা থেকে এসে বান্দরবানের মতো সংবেদনশীল পার্বত্য অঞ্চলে ভুয়া কাগজপত্র ছাড়া কারো পক্ষে স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন বা স্থানীয় পরিচয় গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অথচ এই ব্যক্তি জাল নথি, ভুয়া পরিচয় এবং মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে লামা উপজেলায় জমি ক্রয় করেছেন, যা শুধু প্রতারণা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় রেকর্ড জালিয়াতির এক ঘৃণ্য উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, প্রশাসন যদি দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা আরও বেড়ে যেতে পারে। এতে পার্বত্য এলাকার আইনশৃঙ্খলা, ভূমি নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

আশ্রয় ও সহায়তার বিষয়ে নিয়ে কোয়ামন্ট ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অফিসার ফয়সাল আজিজ বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কোনো ধরনের জালিয়াতি, প্রতারণা বা অবৈধ কার্যক্রমকে আশ্রয় বা সহযোগিতা দেয় না এবং দেবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি মো. মাসুদ পারভেজ এর ব্যক্তিগত আইনগত জটিলতা বা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের কোনো পূর্ব জ্ঞান ছিল না। তিনি যে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে জমির দলিল সম্পাদন করেছেন এমন অভিযোগ আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। বিষয়টি জানার পর প্রতিষ্টানের অভ্যন্তরীণ নীতিমালা অনুযায়ী আমরা তার বিরুদ্ধে নিয়ম অনুসারে প্রতিষ্টান ব্যবস্তা গ্রহণ করবে। আইনি ঝুঁকি বা প্রতারণামূলক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কোনো প্রকার সুবিধা বা সুরক্ষা প্রদান করা আমাদের নীতিবিরোধী। বর্তমানে প্রশাসন যে তদন্ত পরিচালনা করছে, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন তাতে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। প্রয়োজন হলে আমরা আমাদের কাছে থাকা তথ্য-উপাত্তও তদন্তকারী সংস্থার কাছে প্রদান করব। প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট করার মতো কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে আমাদের কেউ যুক্ত নেই। আমরা ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসনে বিশ্বাস করি এবং ভবিষ্যতেও এজন্য কঠোর অবস্থানে থাকব।

অভিযুক্ত মো. মাসুদ পারভেজের অবস্থান জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে তার কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে বারবার কল করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।