প্রচ্ছদ » » স্বস্তিহীন সময়: আতঙ্কে ঘেরা জীবনের গল্প
স্বস্তিহীন সময়: আতঙ্কে ঘেরা জীবনের গল্প
- আপডেট: Thursday, October 9, 2025 - 5:08 pm

সুধীর বরণ মাঝি।।
বাড়ছে ভয়, বাড়ছে আতঙ্ক, বাড়ছে অস্থিরতা। কোথাও কোনো স্বস্তি নেই, নেই কোনো স্বস্তির খবর। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অনিশ্চয়তার চাদর। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণ—কোন খবরটি এখন আর নতুন? সকাল-বিকেল সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায়, মৃত্যুর মিছিল আর কান্নার স্রোত। রাজনীতির মাঠে শিষ্টাচার হারিয়ে গেছে, রাজনীতির নৈতিক অবক্ষয় শুধু প্রশাসনের ওপর প্রভাব ফেলছে না, এর প্রতিফলন পড়ছে অর্থনীতিতেও।
নীতির চেয়ে এখন প্রাধান্য পাচ্ছে ক্ষমতা আর ব্যক্তিস্বার্থ। সরকারি অফিসে সেবা নয়, চলছে ঘুষের প্রতিযোগিতার মহাযজ্ঞ, যেখানে কাজের চেয়ে ‘তেলবাজি’ বেশি কার্যকর। যেন রাষ্ট্র নয়, চলছে ব্যক্তিস্বার্থের মেলা। যেন এক মহাযজ্ঞ—দুর্নীতি, অনিয়ম আর নির্লজ্জ ভণ্ডামির।
আমরা এমন এক সমাজে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষ মানুষের মুখ চেনার আগে ভয় পায়, কেউ কারও ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে না। যারা একসময় দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যাদের হাতে মানুষ দেশের শাসনভার তুলে দিয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল তাদের নীতি, সততা ও প্রজ্ঞায়—একটি নিরাপদ, ন্যায়ভিত্তিক ও সুখী দেশ গড়ার, তারাই আজ আমাদের বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে দিচ্ছেন। তারা শুধু পূর্বসূরীদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন না, বরং সেই পথেই আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছেন—চিতাবাঘের গতিতে। ক্ষমতা মানুষকে কীভাবে পরিবর্তন করে, তা এখন চোখের সামনে স্পষ্ট। কেউ নিজের এবং নিজ প্রতিষ্ঠানে কর মওকুফ করে নেন, আবার সাধারণ নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অন্যায় করের বোঝা। যেখানে ‘জিরো রিটার্ন’ ব্যবস্থা ছিল, সেখানে হঠাৎ কর এক হাজার টাকা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হলো। প্রশ্ন জাগে—এই বৈষম্যের রাষ্ট্রনীতি কাদের জন্য? ধনীরা মাফ পায়, গরিবরা শাস্তি পায়—‘রাজার বেলায় মাফ, প্রজার বেলায় সাত খুন’—এই প্রবাদ এখন বাস্তব চিত্র।
বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সমাজে সৃষ্টি করছে অনিশ্চয়তা ও হতাশা প্রতিদিন দাম বাড়ছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, সবজির। অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব ঠিক আছে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোনো জবাবদিহিতা। সরকারি সংস্থাগুলোর চোখের সামনে জনজীবনের রক্তচোষা ব্যবসা চলছে, অথচ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।নীতিনির্ধারকেরা ব্যস্ত নিজেদের ‘ইমেজ ম্যানেজমেন্টে’, বাস্তব সংকটে নয়। আজ দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। অনেক সময় দেখা যায়,যাদের দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া, তারাই কখনো কখনো সেই নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। অপরাধী ধরা পড়ে, কিন্তু শাস্তি পায় না; মামলা চলে বছরের পর বছর, শেষে ন্যায়বিচার হারিয়ে যায় কাগজের স্তূপে। ফলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। সমাজে জন্ম নেয় এক ভয়ংকর বার্তা—অপরাধ করলেও পার পাওয়া যায়। যখন সমাজে অন্যায়কে সহ্য করার সংস্কৃতি জন্ম নেয়, তখন নৈতিক পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
চাঁদাবাজ, মাদকব্যবসায়ী, কিশোর গ্যাং, মবসন্ত্রাস, সন্ত্রাসী কার্যক্রম—সবই এখন সমাজের এক অনিবার্য বাস্তবতা। আজ কোনো অভিভাবকই নিশ্চিন্তে সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসা দেখতে পারেন না। কোনো শহরেই নিরাপদ বোধ করেন না সাধারণ মানুষ। শহরগুলোতে রাতের পর বের হওয়া মানে ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নিরাপত্তাবোধ, জন্ম নিচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ। রাজনীতি একসময় ছিল জনসেবার মহান পেশা, এখন তা পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভাষা এখন নীতিবোধের নয়, বরং হুমকি-ধমকির। পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টারা জনকল্যাণ নয়, ব্যক্তিস্বার্থে ব্যস্ত। রাজনৈতিক বক্তব্যে শিষ্টাচার হারিয়ে গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি বিদ্বেষই যেন এখন মূল সংস্কৃতি। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে রাজনীতি মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে এক রকম ভয় বা ঘৃণার বিষয়। রাজনীতির এই নৈতিক অবক্ষয়ের সুযোগ নিচ্ছে দেশবিরোধী চক্র, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী শক্তি। এই সুযোগ নিচ্ছে দেশবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। গুজব, অপপ্রচার, বিভাজনমূলক বক্তব্যে ভরে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিভ্রান্তি, ভীতি ও বিভাজন সমাজে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসছে।এর ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি, বিভাজন ও অবিশ্বাস।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো—আমরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ছি। সবচেয়ে বড় সংকট আজ নৈতিকতার। একসময় যেখানে সততা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা ছিল সমাজের চালিকা শক্তি, সেখানে এখন স্থান নিয়েছে লোভ, প্রতারণা আর উদাসীনতা। আত্মজিজ্ঞাসা যেন হারিয়ে গেছে। পরিবারে সন্তান বড় হচ্ছে ‘চতুর’ মানুষ হতে, ‘ভালো’ মানুষ নয়। সমাজে প্রতিযোগিতা চলছে—কে কাকে ঠকিয়ে বেশি সুবিধা নিতে পারে। শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী—সবখানেই লোভ ও প্রতারণা। আত্মজিজ্ঞাসা হারিয়ে গেছে, সৎ থাকা এখন যেন একধরনের বোকামি।মানুষ ভুলে গেছে লজ্জা, বিবেক, সততা। মানুষ যখন হতাশার চূড়ায়, তখনই নতুন আলোর শুরু হয়—সেই বিশ্বাসই টিকিয়ে রেখেছে আমাদের।অর্থনৈতিক বৈষম্য কেবল পকেট নয়, মানুষের বিবেককেও ক্ষয় করছে; এর প্রতিফলন এখন আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও প্রকট।
সত্য বলার সাহসী মানুষগুলো আজ নীরব। যিনি প্রতিবাদ করেন, তিনিই হয়ে যান ‘অসুবিধাজনক ব্যক্তি’। ফলে মানুষ মুখ বন্ধ করে বাঁচতে শিখছে, ন্যায়ের বদলে আপসের পথে হাঁটছে। এভাবে একটি জাতির আত্মা ধীরে ধীরে মরে যায়, শুধু শরীর বেঁচে থাকে। গণমাধ্যম একসময় ছিল রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, আজ অনেক ক্ষেত্রেই সেটি ক্ষমতার দাসে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম একসময় ছিল সত্য প্রকাশের শক্তিশালী হাতিয়ার, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা ক্ষমতার প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞাপন ও প্রভাবের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে নিরপেক্ষতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্র। মানুষ সত্য আর গুজবের পার্থক্য করতে পারছে না। সমাজে নৈতিক নেতৃত্বের অভাব তৈরি হয়েছে, এবং এই শূন্যস্থান পূরণ করছে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী, লোভী রাজনীতিক ও অপরাধী চক্র। রাজনীতির নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যও আজ একই সূত্রে বাঁধা। তবু আশার আলো পুরোপুরি নিভে যায়নি। এখনও এই সমাজে অসংখ্য মানুষ আছেন যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন—শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, তরুণ উদ্যোক্তা। তারা বিশ্বাস করেন, পরিবর্তন সম্ভব যদি আমরা সবাই মিলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, সত্যের পক্ষে কথা বলি। পরিবর্তন শুরু হয় ব্যক্তিগত আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। রাষ্ট্রব্যবস্থার নৈতিকতা ফিরে পেতে হলে আগে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন প্রয়োগে কঠোরতা, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা এবং অর্থনীতিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
যে সমাজ আত্মসমালোচনার ক্ষমতা হারায়, সে সমাজ টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্রকে বদলাতে হলে আগে মানুষকে বদলাতে হবে—এই সত্যই সময়ের দাবি। আজ আমাদের দরকার শুধু নতুন সরকার নয়, নতুন মনন। প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যিনি ভয়ের পরিবর্তে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেন। এমন সমাজব্যবস্থা, যেখানে ঘুষ নয়, যোগ্যতা হবে সাফল্যের চাবিকাঠি। যেখানে মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে, সকালে খবর খুলে পাবে না নতুন হত্যার সংবাদ। একজন নাগরিক হিসেবে এখনই আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে—আমরা কোথায় যাচ্ছি, নিজেকে প্রশ্ন করার, নিজের ভূমিকা বোঝার ? এই অস্থিরতা, এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কি আমরা মেনে নেব, নাকি পরিবর্তনের সাহস দেখাব? সময় এসেছে জেগে ওঠার—মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াবার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। কারণ ইতিহাস কখনও ভুলে যায় না—যারা অন্যায়ের সময়ে নীরব ছিল, তারাও অন্যায়ের অংশীদার হয়। তাই আসুন, জেগে উঠি—নিজের, সমাজের, দেশের জন্য। একটা বৈষম্যহীন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে সকলের অধিকার নিশ্চিত করি। ন্যায়ের পথেই একদিন ফিরে আসবে স্বস্তির ভোর।
পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। রাষ্ট্রে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে পরিবারে, শিক্ষায়, সমাজে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, অর্থনীতিতে ন্যায়বিচার এবং প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলেই মানুষ আবার স্বস্তি পাবে।
লেখক: শিক্ষক-হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর