ঢাকা | অক্টোবর ৬, ২০২৫ - ৫:২২ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

নিম্ন বেতন ও বঞ্চনার শিকার দেশের শিক্ষকরা

  • আপডেট: Sunday, October 5, 2025 - 9:40 am

জাগো জনতা অনলাইন।। নিম্ন বেতন, পদে পদে বঞ্চনা, পেনশন নিয়ে হয়রানি ও সামাজিক মর্যাদার সংকটে দেশের শিক্ষকরা। যে কারণে ক্লাসরুম ছেড়ে শিক্ষকদের নামতে হচ্ছে রাজপথে। পদে পদে শিক্ষকদের এমন বঞ্চনায় তলানিতে নামছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের মান-মর্যাদা না বাড়িয়ে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য সেভাবে ভাবেনি। যে কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় দৈন্যদশাও কাটেনি। এমন বাস্তবতার মধ্যদিয়েই দেশে আজ রোববার (৫ অক্টোবর) পালিত হবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শিক্ষকতা পেশা: মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’।

দেশে হাজারও শিক্ষক রয়েছেন, যারা এখনো বেতন ছাড়াই শিক্ষকতা করছেন। মাদরাসাগুলোতে নামমাত্র যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে সংসারও চলে না। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এক অর্থে সরকারিকরণ হলেও আমাদের এসব শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

মাধ্যমিকের ৯৩ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের বাইরে রয়েছে। এমন বাস্তবতায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরি জীবন শেষের ৪-৫ বছরও নিজের জমানো পেনশনের অর্থ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। দেশের বেসরকারিপর্যায়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়েও কম। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় রাজনীতি, গবেষণা বিমুখতা কার্যত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলছে।

 

প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী!প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন, সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। বেতন গ্রেড ১৩তম। অন্যদিকে মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস একজন ড্রাইভারের গ্রেড ১২তম। সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা এবং বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সর্বসাকূল্যে পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো।

বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এ দেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম।

প্রাথমিকের শিক্ষকরা বলছেন, প্রায় সব শিক্ষক ঋণে জর্জরিত। কারণ এই বেতনে একজন শিক্ষক পরিবারের ভরণপোষণ ঠিকমতো করতে পারেন না। সবচেয়ে বেশি বেতন পান দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শিক্ষকরা। দেশটির প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট, শ্রীলংকায় ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট। ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা রয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতন কাঠামো নিয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ২৮৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এছাড়া ভুটানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন ৩৪১ ডলার ৭২ সেন্ট এবং নেপালে ৪৬৭ ডলার ৪৫ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও শিক্ষকদের গড় বেতন ১৮৯ ডলার ২২ সেন্ট।

 

সারা দেশে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। তারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় বিগত সময়ে বিভিন্ন দাবি তুলেছেন; কিন্তু সেগুলো পূরণ হয়নি। বেতন কাঠামো দশম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিতে প্রায়ই তারা সড়ক অবরোধ, অনশন ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন।

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেইভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি। এ জন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি।

বেতন সাড়ে ১২ হাজার, নামমাত্র বাড়িভাড়ামাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরিজীবনে প্রবেশ করছেন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে। এর সঙ্গে পান নামমাত্র বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা। অবসরের পর বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও মেলে না পেনশনের টাকা। শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার এ সংকট শিক্ষাব্যবস্থায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।

জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন। সরকারি একটি অংশ তাদের বেতনে যুক্ত হলেও বাড়িভাড়া হিসেবে নামমাত্র টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। বর্তমানে একটি প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসক দেখানোর ভিজিট ১০০০-১৫০০ টাকা, সেখানে এসব শিক্ষকের বাড়ি ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দেওয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। যা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ২০ শতাংশ করতে উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরা নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেন। শিক্ষকদের এ কষ্ট দেখার কেউ নেই। রাজনৈতিক সরকার হোক কিংবা অরাজনৈতিক সরকার; কেউ শিক্ষকদের মান-মার্যাদা বাড়ানোর দিকে নজর দেয় না। মুখে সবাই শিক্ষকতাকে মহান পেশা বললেও বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য বিষয়ে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। শিক্ষক দিবসে আমাদের একটাই দাবি, দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষকদের যে চরম বৈষম্য নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হচ্ছে, তা নিরসন করতে হবে।’

রাজনৈতিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রে শিক্ষাব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত ৯ সদস্যের পরামর্শক কমিটির প্রধান হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন।

ড. মনজুর আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার ফলে এ সময়ে এসে তার কুফল আমাদের দেখতে হচ্ছে। শিক্ষা একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতার ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি হয়েছে। শিক্ষা, শিক্ষক, অভিভাবক, কর্তৃপক্ষ কেউ কারও প্রতি সন্তুষ্ট নয়।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করলেও আগামীতে কিছু কাজ বা আলাপ আলোচনা অন্তত চলতো। কিন্তু কোনো ধরনের উচ্চপর্যায়ের কমিটি না থাকায় ভবিষ্যত রাজনৈতিক সরকারও শিক্ষার উন্নয়নে ভালো কিছু করবে, তা এ সময়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।