ঢাকা | অক্টোবর ৬, ২০২৫ - ৯:১৮ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

প্রতিমা তৈরি শেষ, চট্টগ্রামে রংতুলির আঁচড়ে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা

  • আপডেট: Friday, September 26, 2025 - 3:58 pm

অনুজ দেব বাপু, চট্টগ্রাম। আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের মণ্ডপে মণ্ডপে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রতিমা তৈরির শিল্পীরা। কে কত ভালো প্রতিমা তৈরি করে ভক্তদের হৃদয় ছুঁতে পারেন তারই প্রতিযোগিতা চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে। সামর্থ্য অনুযায়ী স্থানীয় এবং অন্য জেলা থেকে শিল্পী এনে প্রতিমা তৈরি করছেন বিভিন্ন পূজামণ্ডপ কমিটি। একেকটি প্রতিমার বাজেট ৩০-৪০ হাজার থেকে শুরু করে ২-৩ লক্ষ টাকা। গত এক-দেড় মাস আগে থেকে প্রতিমাশিল্পীরা শুরু করেন দুর্গাসহ বিভিন্ন প্রতিমা তৈরির কাজ। এখন সবগুলো মণ্ডপেই প্রতিমা তৈরি শেষ। বর্তমানে শিল্পীদের রংতুলির আঁচড়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে একেকটি প্রতিমা। দুর্গাই শুধু নয়, রংয়ের কারুকাজে শিব, অসুর, সিংহ, মহিষ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশের মূর্তিও হয়ে উঠছে বর্ণিল। নগরীর হাজারী লেনের মহামায়া স্টুডিও, সদরঘাটের লোকনাথ শিল্পালয়, নটরাজ শিল্পালয়, স্বর্গীয় দুলাল পাল প্রতিমালয়, দেওয়ানজীপুকুর পাড়ের রূপশ্রী শিল্পালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানের শিল্পীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বৃহৎ এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। তাই দেবী দুর্গার আগমনে দম ফেলবার ফুসরত নেই মৃৎশিল্পীদের। কিছু কিছু মণ্ডপে পূজা উপলক্ষে মণ্ডপ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। জেলা, উপজেলা ও মহানগরীর মণ্ডপ, প্রতিমা তৈরির মাঠ ও মন্দিরগুলোতে এখন চলছে পূজা আয়োজনের শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি।

নগরীর বিভিন্ন প্রতিমালয় ও মণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, রংতুলির আঁচড়ে একেকটি প্রতিমা ফুটিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৃৎশিল্পীরা। প্রায় প্রতিটি শিল্পালয়ে ১৫ থেকে ৪০টি পর্যন্ত প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিমাই বিভিন্ন পূজা মণ্ডপগুলোর আয়োজকদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। প্রতিমার কাজ দ্রুত শেষ করতে সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করছেন কারিগররা। সব প্রতিমার মাটির কাজ শেষে শুরু হয়েছে রং ও সাজসজ্জার কাজ।

মৃৎশিল্পীরা জানান, বিভিন্ন শিল্পালয়ে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে উপকরণগুলোর দাম দ্বিগুণ হওয়ায় সংকটের মুখে পড়ছে এ শিল্প। প্রতিমা তৈরির কাজে এখন খরচ বেশি, মুনাফা কম। কারিগরের সমস্যাও প্রকট। প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যায়ন না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছে।

মৃৎশিল্পীরা আরও জানান, প্রতিমা বানাতে প্রয়োজন হয় পরিমাণ মতো কাঠ, বাঁশ, তারকাটা, রশি, খড়কুটো, এঁটেল ও বেলে মাটি, রং, ধুতি, চুল ও হাতিয়ার। আবার শুধু খড়কুটো ও মাটি দিয়েও করা যায়। প্রতিমা তৈরির ক্ষেত্রে উচ্চতা ও মানভেদে দামের ভিন্নতা রয়েছে। চুক্তি ও মজুরি দু’ভাবেই প্রতিমা তৈরি হয়। চাহিদা অনুযায়ী ক্যাটালগ দেখে আবার কখনো নিজের মতো করে প্রতিমাগুলো তৈরি করেন শিল্পীরা। ক্যাটালগ দেখে করতে পরিশ্রম একটু বেশি হয়। চাহিদা অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৩০-৪০ হাজার থেকে ২-৩ লক্ষ টাকার প্রতিমা তৈরি করেন শিল্পীরা। পারিবারিক সূত্রে ছোটবেলা থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ করে আসছেন অনেকে। তাদের পূর্বপুরুষরাও এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিখিল কুমার নাথ বলেন, এবার নগরীর ১৬ থানায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৯২টি। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রত্যেক পূজা মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের বিষয়ে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। ইতোমধ্যে মেয়র, সিএমপি কমিশনার, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠক করে পূজা ও প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

মৃৎশিল্পী বিশ্বজিৎ পাল জানান, মাটি আর রঙের কাজ শেষে প্রতিমা সাজানোর কাজ চলছে। এবার আমরা ১৪টি মণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরি করেছি।

নগরীর ঐতিহ্যবাহী পূজামণ্ডপ পি কে সেন ভবন পূজা উদযাপন পরিষদের সহ অর্থ সম্পাদক রোহিত চৌধুরী জানান, নারীদের ওপর হওয়া সবরকম অত্যাচার নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র ফুটিয়ে তুলতে এবার তাদের পূজার থিম নির্বাচন করা হয়েছে ‘অপরাজিতা’। এবার তাদের প্রতিমা তৈরি করেছেন বরিশালের শুভ পাল। পূজার বাজেট সাড়ে ৪-৫ লক্ষ টাকা।

আনোয়ারার ঐতিহ্যবাহী পড়ৈকোড়া ঘোষ বাড়ি পূজা পরিষদের মুখ্য সমন্বয়কারী অর্পণ ঘোষ জানান, সর্বশেষ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিমার রংতুলির কাজ চলছে। পরিবারের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে তারা এবার পূজার থিম নির্বাচন করেছেন ‘একচালা ঘর’। প্রতিমা তৈরি করেছেন শুভ পাল। এবার তাদের পূজার বাজেট প্রায় ৩ লক্ষ টাকা।

নন্দীরহাটের শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জীউর মন্দির (ধর্মঘর) দুর্গাপূজা পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন গোস্বামী জানান, আমাদের ঐতিহ্যবাহী পূজা এবার ১৯৫ বছরে পড়েছে। কোনো প্রকার জৌলুস নয়, বরং সাত্ত্বিকভাবে পূজার আয়োজন করা হবে। প্রতিমা তৈরি করেছেন গণেশ পাল। পূজার বাজেট ৫ লক্ষ টাকা।

এদিকে নগরীর বিভিন্ন পরিচিত মার্কেটে দুর্গাপূজার শেষ সময়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে টেরিবাজার, রিয়াজউদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, সানমার ওশান সিটি, আফমি প্লাজা, মিমি সুপার মার্কেট, আমিন সেন্টার, বালি আর্কেডসহ নগরীর বিভিন্ন শপিংমলে দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়।

পূজা উদযাপনের সার্বিক নিরাপত্তায় সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বিবেচনায় এবার পূজামণ্ডপকে তিন ভাগে ভাগ করে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিটি পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। দুর্গাপূজা সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের জন্য প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সভাও হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় দেওয়া হয়েছে ১৭ দফা নির্দেশনা। যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০১৩২০১০৮৩৯৮ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

র‌্যাব-৭, চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্ণেল হাফিজুর রহমান জানান, দুর্গোৎসব উপলক্ষে যেকোনো ধরণের নাশকতা বা কোনো কিছু করার চেষ্টা করছে কিনা এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাসহ সব সংস্থাই কাজ করছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সবার সাথে মিলে সহযোগিতামূলক কাজ করবে।

চট্টগ্রাম জেলার ১৫ থানায় এবার ২,২০২টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে। এর মধ্যে ১,৫৮৫টি প্রতিমা পূজা ও ৬১৭টি ঘটপূজা। আর নগরীর ১৬ থানায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৯২টি।