বন্য প্রাণী ও বনবাসীদের দুর্ভিক্ষ: তামাক চাষ ও বন উজাড়ে সংকট ঘনীভূত

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, লামা (বান্দরবান)।। বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্য প্রাণী ও বননির্ভর মানুষ। বন উজাড়, নদী-ছড়া ভরাট, তামাক চাষের দখলদারিত্ব ও বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে পশুপাখীদের প্রাকৃতিক খাদ্য ও আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একই সাথে বননির্ভর দরিদ্র মানুষও অভাবে দিন কাটাচ্ছে।
সভ্যতার শিকার জীববৈচিত্র্য
বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকুলও সংকটে পড়ছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে—মানুষের বসবাস উপযোগী করতে পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু সভ্যতার নামে মানুষ আজ ভুলে গেছে, বাঁচার অধিকার শুধু মানুষের নয়, পশু-পাখীরও রয়েছে। বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণে দিন দিন অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।
হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের সমৃদ্ধ বনজগৎ
এক সময় লামা থেকে মানিকপুর নদীপথে ভ্রমণ করলে দুই তীর জুড়ে হরিণ, বানর আর শিয়ালের দেখা মিলতো। নিশিরাতে শেয়ালের ডাক ও পাখির গুঞ্জনে গ্রাম কাঁপতো। সকালবেলা ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া, ময়না ও অন্যান্য পাখির উড়াউড়ি চোখ জুড়াতো। বন্য হাতির পাল নির্ভয়ে চলাফেরা করতো। কিন্তু এখন এসব দৃশ্য আর দেখা যায় না।
ঘুঘু, বনমোরগ, মথুরা-হলুদ, বনময়ূরসহ অনেক পাখি আজ বিলুপ্তপ্রায়। তিন-চার দশক আগেও বনময়ূরের ডানা মেলে নাচ দেখা যেত, আজকের প্রজন্ম এসব শুধু গল্পে শুনছে। উল্লুক, ভাল্লুক, অজগরের উপস্থিতিও এখন অদৃশ্য। পাহাড়গুলো সবুজে ঢাকা থাকলেও আজ অনেকটা নিথর ও প্রাণহীন।
নদী-প্রাণী-পাহাড় সবই ইতিহাস
মাতামুহুরী নদী একসময় ছিল গভীর, সর্পিল ও মাছের ভাণ্ডার। রুই, কাতল, বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ ভেসে উঠতো। পাহাড়জুড়ে ছিল নানা প্রজাতির ফল, ফুল ও সবজি। এগুলো স্থানীয় বাজারে সরবরাহ হতো এবং মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণে সহায়ক ছিল। এখন এসব কেবল ঘুমন্ত ইতিহাস।
খাদ্য ও আশ্রয় সংকটে হিংস্র প্রাণী
খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থল সংকটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্য হাতির পাল লোকালয়ে ঢুকে হিংস্র আক্রমণ করছে। শিকারীদের আগ্রাসনে অনেক পাখি ও প্রাণী বিলুপ্তপ্রায়।
তামাক চাষ: ধ্বংসের মূল চালিকা শক্তি
চার দশক ধরে তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদেরকে তামাক চাষে অভ্যস্ত করে তুলেছে। এখন বসতবাড়ি ছাড়া প্রায় সব জমিতেই তামাক হয়। সেচযোগ্য জমি, নদীর তীর ও ছড়া-নালার জমি দখল করে তামাক চাষ হচ্ছে।
একটি জমিকে তামাকের উপযোগী করতে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, ফলে মাটি পাউডারের মতো হয়ে যায়। বর্ষায় এসব মাটি বৃষ্টির পানিতে মিশে নদী-ঝিরি ভরাট করে।
এছাড়া তামাক কিউরিং করতে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন কাঠ পোড়ানো হয়। পাহাড়ের গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে মাটির জৈবশক্তি কমছে, মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে, কীটপতঙ্গ ও পাখির খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব
পরিবেশবিদদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব প্রায় ৩০ বছর পরপর প্রকট হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘন ঘন বন্যা, অতিরিক্ত শীত ও গরম সেই প্রমাণ বহন করছে।
টেকসই সমাধান কী?
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, সভা-সেমিনারে শুধু বক্তৃতা না করে তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলা দরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইকো ভিলেজ সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। প্রতিটি রাবার বা বনজ বাগানের একাংশে মিশ্র ফলদ বাগান গড়ে তুললে পশুপাখীর নিরাপদ আবাস তৈরি হবে।
সরকারের কৃষি ও বন বিভাগ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি মানুষেরও নিরাপদ খাদ্যচাহিদা পূরণ হবে।
সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবছর আয়োজিত ফলদ-বনজ বৃক্ষমেলায় শুধুমাত্র ফলের গুণাগুণ নয়, বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা দরকার। তাহলেই প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং মানুষের পাশাপাশি প্রাণীকুলের টিকে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।