ঢাকা | সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫ - ২:২৬ অপরাহ্ন

শিরোনাম

২০ বছর সাজা খাটা দুই হাজার কয়েদির মুক্তির সুযোগ

  • আপডেট: Tuesday, September 16, 2025 - 6:26 am

নিজস্ব প্রতিবেদক।। দেশে দুই হাজারের মতো বন্দি রয়েছেন, যারা যাবজ্জীবন সাজার অংশ হিসেবে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন। কারাবিধি অনুযায়ী, সরকার চাইলে তাদের বিশেষ বিবেচনায় মুক্তি দিতে পারে।

১৮৬০ সালের পেনাল কোড অনুযায়ী, বাংলাদেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর। এটি কমিয়ে যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে আনার কথাও ভাবছে সরকার।

গত জুলাই মাসে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে অন্তত ২০ বছর কারাগারে ছিলেন– এমন ২৯ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। যারা রেয়াতসহ ২০ বছর সাজা ভোগ করেছেন, তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে এদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কারাবিধি ৫৬৯ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার এই বন্দিদের সাজা মওকুফ করে। এ নিয়ে চলতি বছরে ১০৭ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। কারাবিধির ৫৬৯ ধারা অনুসারে, কোনো বন্দি সাজার মেয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ খাটার পর তাকে মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। তবে তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকলে তা করা যাবে না।

এই ধারায় বন্দির বয়স, সাজার ধরন, মেয়াদ, শারীরিক অবস্থা এবং কারাগারে কোনো অপরাধ না করলে সাধারণত বিশেষ বিবেচনায় তাকে মুক্তি দেওয়ায় সুযোগ আছে। এর জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনেরও প্রয়োজন হয় না।

গত রোববার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ কমানোর বিষয়টি সামনে আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বয়স বিবেচনায় নারীদের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ হতে পারে ২০ বছর। পুরুষদের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ আরেকটু বেশি হবে।

তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের এ বিধান নির্ভর করবে সাজার সময়ে আসামির বয়সের ওপর। এ বিধান এখনও চূড়ান্ত হয়নি এবং এতে কিছু শর্ত যুক্ত থাকবে।

কারা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে কারাগারে ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী বন্দি আছে ৯ হাজার ৩৪৪ জন। তাদের মধ্যে হাজতি (বিচার চলছে) সাত হাজার ৬১৪ এবং কয়েদি (সাজা হয়েছে) এক হাজার ৭৩০ জন। ২৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী বন্দি আছে ১৮ হাজার ৯৫৬ জন। এর মধ্যে হাজতি ১৪ হাজার ৬৫৬ ও কয়েদি চার হাজার ৩০৯ জন। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী বন্দি আছে ২১ হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে হাজতি ১৬ হাজার ৩০৫ ও কয়েদি পাঁচ হাজার ৩১০ জন। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী বন্দি কারাগারে থাকা মোট বন্দির ৬৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ।৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী বন্দি আছে ১৫ হাজার ৭১২ জন। এর মধ্যে হাজতি ১১ হাজার ৪০৮ ও কয়েদি চার হাজার ৩০৪ জন। ৫১ থেকে ৫৯ বছর বয়সী আছে আট হাজার ৭৫৬ জন।
কারাগারগুলোয় ৬০ বছরের বেশি বয়সী বন্দি আছে তিন হাজার ৬১৮ জন। দেশের ৭৪টি কারাগারে বন্দির ধারণক্ষমতা ৪৩ হাজার। বর্তমানে বন্দি আছে ৭৮ হাজার একজন।

কারা সূত্র আরও জানায়, বন্দিদের মধ্যে দুই হাজার ৮০০ নারী। ২৫৪ শিশু রয়েছে, যারা মায়ের সঙ্গে কারাগারে আছে। বন্দিদের মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব আছে ৩৬২ জন। তাদের মধ্যে নারী ১৭ ও পুরুষ ৩৪৫ জন।

কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন  বলেন, বিচার ব্যবস্থাপনা আরও ত্বরান্বিত করা গেলে কারাগারে বন্দির সংখ্যা ও চাপ কমবে। বন্দিদের মধ্যে ৫৯ হাজার হাজতি। মানে এদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। আর কয়েদির সংখ্যা ১৯ হাজার। তিনি জানান, বন্দির চাপ কমাতে নতুন পাঁচটি কারাগার চালুর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে দুটি চালু করা হয়েছে।

কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোট বন্দির মধ্যে আড়াই হাজার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত। দুই হাজার বন্দি আছেন যারা যাবজ্জীবন সাজার ২০ বছর খেটেছেন। বন্দির তালিকায় বিদেশি নাগরিক আছেন ৩৯৬ জন।

মাদক মামলার আসামি ২৪.৫%
কারাবন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদক মামলার আসামি। সব মিলিয়ে ১৯ হাজার বন্দি মাদক মামলায় সংশ্লিষ্ট। এই হার মোট বন্দির প্রায় ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।

নারী-পুরুষের সংখ্যা
কারাগারে কয়েদিদের মধ্যে ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী পুরুষ এক হাজার ৬৬৫ জন; নারী ৬৫ জন। ২৩ থেকে ৩০ বছর বয়সের পুরুষ কয়েদি তিন হাজার ৪৭১ জন ও নারী ৮৩৮ জন। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ কয়েদি চার হাজার ৬৩ জন ও নারী ২৫০ জন।

এ ছাড়া হাজতির মধ্যে ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সের পুরুষ সাত হাজার ৩৫৯, নারী ২৫৫ জন। ২৩ থেকে ৩০ বছরের পুরুষ ১৩ হাজার ৫৪৭ জন, নারী এক হাজার ১০৯। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সের পুরুষ ১৫ হাজার ৬৯৫ ও নারী ৬১০ জন।

অতীতে যারা মুক্তি পেয়েছেন
২০১০ সালের আগস্টে তৎকালীন সরকার এক হাজার বন্দিকে মুক্তি দেয়। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির বেশির ভাগই হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তখন কারা কর্তৃপক্ষ বলেছিল, যেসব আসামী ২০ বছর সাজার মেয়াদ শেষ করেছে, তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে এক হাজার জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারাগারে যারা সদাচরণ করেছেন, তারাই মুক্তি পেয়েছেন।

২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বন্দিমুক্তির একটি তথ্য পাওয়া গেছে। তখন তিন হাজার ৯৩৪ জন কারাবন্দি বিশেষ দিনগুলোতে মুক্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৯৭১ জন, ২০১০ সালে এক হাজার ৬৪১, ২০১১ সালে ৪৯৭, ২০১২ সালে ১৩৬, ২০১৩ সালে ৪৮৯, ২০১৪ সালে ৪২, ২০১৫ সালে ৪০, ২০১৭ সালে ৫১ এবং ২০১৮ সালে সাতজন কারাবন্দি মুক্তি পান।

কারেকশন সার্ভিসেস বাংলাদেশ
সম্প্রতি কারাগারের নাম পরিবর্তন করে ‘কারেকশন সার্ভিসেস বাংলাদেশ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বন্দিদের উৎপাদনমুখী করার জন্য সুবিধাজনক স্থানে ‘কারেকশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিবছর ৫০ হাজারের মতো সক্ষম জনবল কারাগারে অবস্থান করে। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫ হাজার জনবলকে যদি উৎপাদনমুখী করা যায়, তাহলে সরকারের রাজস্ব সাশ্রয় হবে। আবার বন্দি অনেকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তারাও কারাগার থেকে করা আয় পাঠিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা দিতে পারবেন।

কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৪ আগস্ট সারাদেশের কারাগারে বন্দি ছিলেন ৮৮ হাজার। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১২ আগস্ট বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ হাজারে। এর পর বন্দির সংখ্যা বাড়তে থাকে। গতকাল পর্যন্ত সব কারাগার মিলে বন্দি ৭৮ হাজার ১ জন। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ সদস্যসহ এখন কারাগারে আছেন দুই শতাধিক। তাদের মধ্যে ডিভিশন পাচ্ছেন ১৫৩ জন।