ঢাকা | ডিসেম্বর ২৫, ২০২৫ - ৯:১৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও নেই কৃষি শ্রমিকের মজুরি কাঠামো

  • আপডেট: Thursday, December 25, 2025 - 6:59 pm

মো. মুজিব উল্ল্যাহ্ তুষার।

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের জাতীয় আয়ের একটি বিশাল অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৬৩ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। দেশের অর্থনীতি এখনো নির্ধারিত হয়ে থাকে কৃষি উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হলো ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর। প্রতি কৃষকের আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ১.৫০ একর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। ২০০৩ সালে তা কমে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। গড়ে প্রতি বছর ৪০ হাজার একর আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমি কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা হলো ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমান জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যার ফলশ্রুতিতে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর জনসংখ্যাই বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কৃষির যে শক্ত ভিত গড়ে উঠেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে একাধিক গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। নারী ও তরুণদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিকে নতুন দিক দিয়েছে। ভবিষ্যতের কৃষি হবে প্রযুক্তিনির্ভর, ন্যায্যমূল্যমুখী ও টেকসই এবং প্রিসিশন ফার্মিং, স্মার্ট গ্রিনহাউস, এআই, বায়োইনফরমেটিকস ও ড্রোনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কৃষিকে পুনর্গঠন করবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ‘কৃষক থেকে ভোক্তা’ সরাসরি বিপণন কাঠামো জরুরি, যা মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে কৃষকের প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করবে। কৃষিকে টেকসই করতে এখনই প্রয়োজন কৃষিবান্ধব রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সংস্কার। দলীয় ম্যানিফেস্টোতে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বাড়িয়ে মোট বাজেটের ৮–১০ শতাংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ এবং কমপক্ষে ২০ শতাংশ গবেষণা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। ফসলের ন্যূনতম ক্রয়মূল্য আইনে বাধ্যতামূলক করা, কৃষকের জন্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা কার্ড চালু, ভর্তুকি ও ঋণ সুবিধায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, হিমাগার ও বাজারকেন্দ্র উন্নয়ন করলে কৃষকের আয় বাড়বে; পাশাপাশি অবৈধ জমি দখল রোধে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কৃষি-ল্যান্ড সুরক্ষা আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। নারী কৃষকের অধিকার ও জমির মালিকানা নিশ্চিত করা এবং তরুণদের জন্য কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর, মর্যাদাপূর্ণ ও লাভজনক পেশায় রূপান্তর করাও সময়ের দাবি। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত কৃষকের প্রতিনিধিত্ব ও নীতিনির্ধারণে গবেষক-প্রযুক্তিবিদদের সম্পৃক্ততা বাড়ালে কৃষি হবে আরও বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই। কৃষককে ভোটব্যাংক নয়, দেশের অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কৃষক খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি। তাদের পরিশ্রমেই দেশ আজ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে কৃষকের সম্মান রক্ষা, ন্যায্য আয় নিশ্চিত এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করা জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর, ন্যায্যমূল্যমুখী এবং কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর ফলে কৃষক শুধু উৎপাদক নয়, উন্নয়নের নেতৃত্বে থাকা শক্তি হিসেবে অবস্থান করতে পারেন।
দেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরও এ খাতের শ্রমিকদের জন্য গঠিত হয়নি ন্যূনতম মজুরি কাঠামো। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে। আরেক প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও কৃষি শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতেও কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে।
বাংলাদেশে খাতভিত্তিক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে থাকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নিম্নতম মজুরি বোর্ড। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের ৪৭টি শিল্পের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে শিল্প ব্যতীত ‘শ্রমিক’-এর জন্য নির্ধারিত মজুরি কাঠামোর ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে—কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকরা এ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে প্রচলিত কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা না থাকলেও কৃষির অন্তর্ভুক্ত চিংড়ি, মৎস্য শিকার ট্রলার শিল্প, রাবার শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ শিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো রয়েছে।
কৃষির মূল উপাদান শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের জন্য দেশে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকায় এ পেশায় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এলাকাভেদে ও ফসলের মৌসুমভেদে শ্রমিকদের চাহিদা বাড়লে মজুরি বৃদ্ধি পায়, অন্য সময়ে তা কম থাকে। এছাড়া ন্যূনতম কাঠামো না থাকায় মজুরিতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তীব্রভাবে ফুটে ওঠে।
দেশের কৃষি খাত বরাবরই উপেক্ষিত। সেই সঙ্গে এ খাতের শ্রমিকদের মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি সবসময় আড়ালে থেকে যায়। ‘কৃষি শ্রমিক, গ্রামের দিনমজুরদের নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের মানবাধিকারের বিষয়টি সবসময় উপেক্ষিত থাকছে। অথচ তারাই আমাদের খাদ্যের জোগান দেন। ন্যূনতম মজুরি কাঠামো না থাকার কারণে এখনো নারী-পুরুষের মজুরিতে ব্যাপক বৈষম্য রয়ে গেছে। আমাদের দেশে আন্দোলন ছাড়া কিছু হয় না। অথচ এখানে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন নেই। ফলে পলিসি পরিবর্তনের মতো কোনো উদ্যোগও দেখতে পাই না।’
রাজধানী ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে শহরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান প্রত্যাশীদের চাপ। কৃষি শ্রমিকের আর্থিক নিরাপত্তায় কোনো উদ্যোগ না থাকায় গ্রাম ছেড়ে অনেকেই শহরে ছুটছেন। ফলে ফসলের মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় কৃষি শ্রমিক সংকট মারাত্মক রূপ নেয়। তাদের সুরক্ষায় নীতি প্রণয়ন হলে সেটি সরাসরি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় প্রভাব তৈরি করবে। কৃষি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা গেলে লিঙ্গভিত্তিক মজুরি বৈষম্য কমবে। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে এবং কমবে নগরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের চাপ।