ঢাকা | অক্টোবর ১৬, ২০২৫ - ৮:৪২ অপরাহ্ন

শিরোনাম

সুন্দরবনে টেকসই পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও করণীয়

  • আপডেট: Thursday, October 16, 2025 - 6:24 pm
মো. মামুন হাসান।। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সুন্দরবন শুধু বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনই নয়, এটি জলবায়ু সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সবুজ অর্থনীতির এক অনন্য প্রতীক। এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে দেশের পর্যটন উন্নয়নে ২০ বছর মেয়াদি একটি ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সুষম ভারসাম্য স্থাপন করবে।

মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপ হলো টেকসই পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলা। সুন্দরবনের ভেতরে পরিবেশবান্ধব ইকো লজ, নদীপথ পর্যটন ব্যবস্থা, হাঁটার ও সাইক্লিং পথ এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করা হবে। পাশাপাশি তথ্যকেন্দ্র ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, যেখানে বনসম্পদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, পর্যটন ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা পরিচালিত হবে।

এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা। সুন্দরবনের আশেপাশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বননির্ভর জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের জীবিকা টেকসই পথে রূপান্তর করতে হবে, যাতে তারা বনসম্পদের উপর অতি নির্ভরশীল না থাকে। স্থানীয় মানুষদের হস্তশিল্প, ইকো স্মারক উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব নৌভ্রমণ, গাইডিং এবং অতিথি সেবার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এতে একদিকে তাদের আয় বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে বন সংরক্ষণ আরও কার্যকর হবে। তরুণ প্রজন্ম প্রশিক্ষিত হয়ে ট্যুর গাইড, রিসোর্ট ম্যানেজার, ট্যুর অপারেটর ও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজস্ব কর্মজীবন গড়ে তুলতে পারবে।

সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা সুন্দরবনের পর্যটন ব্যবস্থাপনা, ইকো রিসোর্ট পরিচালনা, ট্যুর পরিকল্পনা এবং বিদেশি পর্যটকদের আতিথেয়তায় পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবে। সুন্দরবন ট্যুরিজম রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা, ইন্টার্নশিপ এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুন্দরবনের পর্যটন উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। এই সেলটি হবে জ্ঞানচর্চা, উদ্ভাবন ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের কেন্দ্র, যা একদিকে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলবে, অন্যদিকে সুন্দরবনের টেকসই পর্যটন বিকাশে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

সুন্দরবনে টেকসই পর্যটন পরিচালনায় প্রযুক্তির ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন বুকিং সিস্টেম, পর্যটন তথ্য প্ল্যাটফর্ম এবং জরুরি সেবা ব্যবস্থাপনা চালু করা গেলে ভ্রমণ আরও নিরাপদ ও আকর্ষণীয় হবে। প্রতিটি প্রবেশপথে স্মার্ট টিকিটিং এবং পর্যটক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা হলে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। পাশাপাশি সৌরচালিত নৌকা ও পরিবেশবান্ধব ক্রুজ সার্ভিস চালু করা হলে দূষণ কমবে এবং পর্যটকদের অভিজ্ঞতা হবে আরও মনোমুগ্ধকর।

সুন্দরবনকে লাভজনক ও টেকসইভাবে পর্যটনে ব্যবহার করতে হলে স্থানীয় জনগণের নেতৃত্বে কমিউনিটি ট্যুরিজম গড়ে তোলা জরুরি। ছোট ছোট পর্যটন গ্রাম তৈরি করে সেখানে বিদেশি ও দেশি পর্যটকদের স্থানীয় জীবনধারা, লোকসংগীত, রান্না ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা উপভোগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে স্থানীয়দের আয় বাড়বে এবং বনসম্পদের ওপর চাপ কমবে। একইসঙ্গে সুন্দরবনের মধু, চিংড়ি, ম্যানগ্রোভ ফল ও হস্তশিল্প আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্র্যান্ডিং করলে নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং দেশের রাজস্ব বাড়বে।

বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারণা জোরদার করা প্রয়োজন। সুন্দরবনকে “The Living Heritage of Bangladesh” হিসেবে বিশ্ব পর্যায়ে উপস্থাপন করা যেতে পারে। বহুভাষায় ওয়েবসাইট ও প্রচারণা ভিডিও তৈরি করে আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত। বিদেশিদের জন্য বিলাসবহুল, কিন্তু পরিবেশবান্ধব ক্রুজ ট্যুর, লোকসংগীত সন্ধ্যা, স্থানীয় খাবার আস্বাদন ও বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ প্যাকেজ চালু করা গেলে তারা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হবে। পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং “খুলনা, সুন্দরবন, মংলা ও কুয়াকাটা” পর্যটন করিডর চালু করা হলে বিদেশি পর্যটকদের আগমন আরও বাড়বে।

সবশেষে বলা যায়, সুন্দরবনের ২০ বছর মেয়াদি ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান কেবল একটি প্রকল্প নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি সংরক্ষণ ও সবুজ অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন হয়ে উঠবে টেকসই উন্নয়নের এক উজ্জ্বল প্রতীক, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও অর্থনীতি মিলেমিশে সুরেলা সমৃদ্ধির নতুন ইতিহাস রচনা করবে।

লেখক: ইনস্ট্রাক্টর (টেক) ও বিভাগীয় প্রধান
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।