ঢাকা | সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ - ১:০৩ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের শেষ কোথায়?

  • আপডেট: Wednesday, June 21, 2023 - 3:56 pm

আমাদের দেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানি নতুন কোনো ঘটনা নয়। অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে চললেও বিগত কয়েক দশকে দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে; যা দেশের গণমাধ্যম জগতের জন্য এক অশনিসংকেত। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো সংবিধানস্বীকৃত স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করে, যা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, যে কোনো সময়কার ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত হামলা-মামলা-নির্যাতন ও হত্যা স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে, যার সর্বশেষ নিদর্শন জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী হত্যাকাণ্ড। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক-২০২৩-এর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুবছরে বাংলাদেশ (গণমাধ্যম সূচকে) ১১ ধাপ ও ১৪ বছরে ৪২ ধাপ নিচে নেমেছে। যে বিষয়গুলোর ওপর এই সূচক নির্ধারিত হয়, তার অন্যতম একটি বিষয় হলো সাংবাদিকের নিরাপত্তা। আর ঠিক সেখানেই বাংলাদেশের স্কোর হতাশাজনকভাবে কম। দেশে বারবার সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিচার না হওয়া, ‘অদৃশ্য শক্তির’ প্রভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ার ফলে দেশে এ ধরনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বলাবাহুল্য। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিচারহীনতা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নিঃসন্দেহে এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

গত বছর (২০২২) মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র তথ্যমতে, গত ১০ বছরে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩০ সাংবাদিক। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়ার নজির খুব কমই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিক হত্যার বিচার ঝুলে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতায়। শুধু গত এক দশকেই নয়, তার আগের হত্যাকাণ্ডগুলোরও বিচারের নজির মিলছে কম। বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ‘আর্টিকেল-১৯’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এ হার হয় ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সাংবাদিকদের হয়রানির পরিমাণ বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। হয়রানির মধ্যে মানহানির দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে ২১৩ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে চারজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, গুরুতর জখম হয়েছেন ৪০ জন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পেশাগত কারণে ২৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শুধু সমকাল পত্রিকার ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান গৌতম দাস হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ঘটনার প্রায় সাড়ে ৭ বছর পর ২০১৩ সালের ২৬ জুন নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১০ সালে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের হাতে চারজন খুন ও দুজন অপহরণসহ ৩০১ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওই সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০১৪ সালে দুজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, ২৩৯ জন সংবাদকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ‘ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ২১২টি ঘটনায় ৫১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতিসহ খুন হয়েছেন পাঁচ সাংবাদিক। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম হাউজ’র ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারে বিশ্বের ১৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। এর আগে ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২০১২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ প্রকাশিত ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৪ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬। সূচকে বাংলাদেশের অবনতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এর আগে ২০১৩ সালে ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৪।

একের পর এক সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনায় এ দেশ ইতোমধ্যে এশিয়া মহাদেশে প্রথম স্থানও অধিকার করেছে। আশ্চর্যের বিষয়, দেশে বারবার সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন এবং হয়রানির ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বললেই চলে। সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হামলাকারীরা ‘অদৃশ্য শক্তি’র প্রভাবে ছাড় পেয়ে যাওয়ার ঘটনাও সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও হয়রানিকে ত্বরান্বিত করছে। আর এ কারণেই হয়তো সাংবাদিক সাগর-রুনী, শামসুর রহমান, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ অনেক সাংবাদিকদের পরিবার দীর্ঘদিনেও তাদের স্বজন হারানোর বিচার পান না। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গণমাধ্যমের রয়েছে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা, রোধ করার চেষ্টা করা কিংবা গণমাধ্যমকে সংসদের বিপরীতমুখী ভাবা অথবা গণমাধ্যমকর্মীদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করা নিশ্চয় কোনো শুভ বিষয় হতে পারে না। কারণ, দেশের টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদ ও সংবাদপত্রের ভূমিকা বিপরীতমুখী নয়। বরং তা একে অপরের পরিপূরক। রাজনীতিবিদদেরই স্মরণ রাখা প্রয়োজন, গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক অবিভাজ্য এবং অবিচ্ছেদ্য। একজন রাজনীতিবিদের গণমাধ্যমের প্রতি সম্মানবোধ থাকা উচিত এবং গণমাধ্যমেরও দায়িত্বশীলতা পালন করা আবশ্যক। কারণ, এ দুটি বিষয় সব সময়ের জন্যই গণতন্ত্রের জন্য অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয়। গণমাধ্যম ও রাজনীতি যেহেতু একে অপরের পরিপূরক, সম্পূরক এবং সাহায্যকারী, তাই এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে তা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসাবে গণ্য হবে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, দেশে অগণতান্ত্রিক চর্চা, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যম সব সময়ই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে হ্যাঁ, যদি কখনো কোনো সংবাদপত্রে বা কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অসত্য ও ভিত্তিহীন হয়, তবে যার বিরুদ্ধে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তিনি বা সেই সংস্থা বা সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ হতেই পারেন। সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধরা প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ পাঠালে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বা গণমাধ্যম ওই প্রতিবাদ ছাপাতে বাধ্য। এছাড়া তারা প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিল বা আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। বর্তমানে দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আর অনলাইন পোর্টাল যেন কুটিরশিল্পে রূপ নিয়েছে, এর সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। ফলে সাংবাদিকতা ছাড়াও অনেকে নানা উদ্দেশ্যে এ পেশায় ঢুকে পড়েছেন, এটাও গণমাধ্যমের জন্য ক্ষতিকর। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর হয়ে উঠছে, সাংবাদিকদের মধ্যে বিরাজমান বিভেদ ও বিভাজনগুলো। এক্ষেত্রে সব সাংবাদিকের উচিত হবে এসব বিভেদ-বিভাজন ভুলে সাংবাদিকতার সঠিক পথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। যা হোক, দেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে আজ আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায় না। দেশের সরকার এবং জনগণ নিশ্চয় সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। দেশ ও জনগণের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থেই সাংবাদিক ও সংবাদপত্র দমননীতির মনোভাব প্রকাশ থেকে সবারই দূরে থাকা উচিত। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো সাংবাদিককে হত্যা-নির্যাতনের শিকার না হতে হয়, তাদের ওপর আর যেন কোনো ধরনের অন্যায় জুলুম, নির্যাতন, হয়রানি না চলে সে বিষয়গুলো সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দেশে সংঘটিত সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা তথা তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশসহ সবকিছুই বাধাগ্রস্ত হবে, যা কারও কাম্য নয়।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ভিজিটিং প্রফেসর, লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটি এবং চণ্ডীগড় ইউনিভার্সিটি (পাঞ্জাব, ভারত)।