ঢাকা | ডিসেম্বর ৯, ২০২৫ - ৭:০৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম

সফল জননী নারীর সম্মাননা পেল কাপ্তাইয়ের সন্ধ্যা রানী দাশ

  • আপডেট: Tuesday, December 9, 2025 - 4:44 pm

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই (রাঙামাটি) প্রতিনিধি। রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ পক্ষ এবং বেগম রোকেয়া দিবসে সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে “অদম্য নারী সম্মাননা” পেলেন ৮০ বছর বয়সী সন্ধ্যা রানী দাশ। তিনি কাপ্তাই উপজেলার ১ নং রাইখালী ইউনিয়নের মৃত সুধীর রঞ্জন দাশের সহধর্মিণী।

কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের আয়োজনে আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ পক্ষ এবং বেগম রোকেয়া দিবসে সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে তাঁকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০ টায় কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষ ‘কিন্নরী’-তে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রুহুল আমিন।
কাপ্তাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রিনি চাকমা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

এসময় কথা হয় অদম্য নারী সম্মাননা প্রাপ্ত সন্ধ্যা রানী দাশের সাথে। তিনি বলেন, আমি মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পেরেছি। আমার বাবার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কদমতলী গ্রামে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের রাইখালী বাজার নিবাসী সুধীর রঞ্জন দাশের সাথে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী ছিলেন অকালে পিতৃমাতৃহীন একজন আজন্ম শ্রমজীবী মানুষ। পরের ঘরে কৃষিকাজ করতেন, মাঝে মাঝে হাট-বাজার কিংবা মেলায় ভাসমান দোকানের পসরা সাজাতেন। বিয়ের পর আমি জীবিকার সংগ্রামে স্বামীর সহযাত্রী হই। নিজেদের কোন জমি ছিল না। পরের জমিতে বর্গাচাষ করে কোনমতে ভাতের সংস্থান করতেন তিনি। অভাবে সংসারে আমি ৩ ছেলে এবং ২ মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। আমার বড় ছেলে ডাঃ নারায়ণ চন্দ্র দাশ (এমবিবিএস, এমপিএইচ, ডিএমইউ), বিসিএস স্বাস্থ্য, চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক (কমিউনিটি মেডিসিন), মেজ ছেলে রতন চন্দ্র দাশ বি.কম, সি ইন এড—প্রধান শিক্ষক রাইখালী জুমিয়া পুনর্বাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট সুমন চন্দ্র দাশ এলএলবি (অনার্স), এলএলএম (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)—এডভোকেট, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট এবং সিনিয়র প্যানেল ল’ইয়ার উত্তরা ব্যাংক পিএলসি।

আমার দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে লক্ষ্মী রানী দাশ বিএ পাস—মহিলা উদ্যোক্তা এবং ছোট মেয়ে অনিতা দাশ বিএসসি, বিএড, এমএ (কাব্যতীর্থ)—বিবাহিত, সিনিয়র শিক্ষক রাউজান গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি আরও জানান, আমার বড় ছেলের বউ ডাঃ রোজী দাশ এমবিবিএস, এমসিপিএস (গাইনি), এফসিপিএস (এফ.পি)—আবাসিক সার্জন, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম; আমার নাতি আদিত্য দাশ উৎস—বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার (ইইই), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি ছাত্র, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি অব স্যান অ্যান্তোনিও, টেক্সাস, ইউএসএ; এবং নাতনি মনিষা দাশ মুমু—এইচ.এস.সি (২০২৫) গোল্ডেন এ+, চট্টগ্রাম কলেজ।

আমার নাতির বউ প্রজ্ঞা পারমিতা পাল—বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; এম.এস.সি ছাত্রী, টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি অব স্যান মার্কোস, টেক্সাস, ইউএসএ। এছাড়া আমার ছেলে রতন চন্দ্র দাশের সহধর্মিণী অনিতা দাশ বিএ পাস। তাঁর মেয়ে অনিন্দিতা দাশ তিতি—বি.এস.সি (অনার্স, প্রাণীবিদ্যা), চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত। তাঁর ছেলে অরিদ্র দাশ—এইচ.এস.সি পাস (২০২৫), জিপিএ–৫.০০, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।

সফল জননী নারী সম্মাননাপ্রাপ্ত সন্ধ্যা রানী দাশের বড় ছেলে চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক ডা: নারায়ণ চন্দ্র দাশ বলেন, ধান পাকার মৌসুমে আমার মায়ের কাজ ও কষ্ট দুটোই বেড়ে যেত। ভাসমান দোকান নিয়ে বাবা প্রায়ই বাইরে থাকতেন। ধান মাড়ানো, শুকানো থেকে গোলায় ভরা—সব কাজ মা অনেকটা একাই করতেন। এক বছর জমির ধান বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেলো। ফলে বাবার ভাসমান দোকানের পুঁজিতে টান পড়লো। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেলাম। ষষ্ঠ শ্রেণীর বই কিনতে পারছিলাম না। বাবার চোখে ছেলেকে সুশিক্ষিত করার কঠিন স্বপ্ন, কিন্তু আর্থিক দৈন্যতা বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তখন মা এগিয়ে এলেন। উনার বিয়েতে দাদুর দেওয়া একমাত্র গলার স্বর্ণের চেইনটা বাবাকে দিয়ে বললেন, “এই চেইনটা বিক্রি করে ব্যবসায় পুঁজি দাও, কিছু নিজের জমি কিনো।” অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবা চেইনটা বিক্রি করে কিছু সস্তা ধান্য জমি কিনলেন আর চানাচুর তৈরির সরঞ্জাম কিনলেন। বাবা চানাচুর তৈরির সরঞ্জাম এনে দিতেন আর মা বাসায় চানাচুর তৈরি করে প্যাকেট করতেন। বাবা বাজারে বিক্রি করতেন।

এভাবে চানাচুরের পর বাবা হলুদ ব্যবসায় লেগে গেলেন। বস্তার পর বস্তা কাঁচা হলুদ মা সিদ্ধ করে শুকাতেন, আর বছর শেষে মৌসুমে বাবা বিক্রি করে যৎসামান্য লাভ করতেন। ভারী কাজের চাপে আমার মায়ের শরীর শীর্ণকায় হতে লাগল। তখন চিকিৎসা ছিল অপ্রতুল। বছরে এক জোড়া কাপড় জোড়াতালি দিয়ে আমার মা পড়তেন। বাবা নতুন শাড়ির কথা তুলতেই মা বলতেন, “আমার ছেলে ডাক্তার হলে আমাকে ভাল শাড়ি কিনে দিবে।” আমার মা ছিলেন খুব কষ্টসহিষ্ণু, মিতব্যয়ী, শিক্ষানুরাগী। আমাদের ভাত-তরকারি খেতে দিয়ে নিজে প্রায়ই রুটি খেতেন। ছোটবেলা আমরা ৫ ভাইবোনকে পড়াতেন। রামায়ণ, মহাভারতের পৌরানিক কাহিনী শোনাতেন। শারদীয় দুর্গাপুজায় সুর করে জাগরণী পুঁথি পাঠে আমার মা আমাদের এলাকায় অদ্বিতীয়। তবে আমার মেডিকেল পড়াকালীন সময়ে আমার কাকা চিত্তরঞ্জন দাশ আমাকে সহায়তা করেছেন।

সন্ধ্যা রানী দাশের মেজ ছেলে প্রধান শিক্ষক রতন চন্দ্র দাশ বলেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য আমার মা কোনদিনও কারো মুখাপেক্ষি হননি। দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থেকে পড়াশোনা করানো ছিল আমার মায়ের প্রধান ব্রত। আমাদের বাসায় কোন টেবিল-চেয়ার ছিল না। মাটিতে বসে খেতাম, পড়াশোনা করতাম। জ্বালানির কাঠের অভাবে সেগুন পাতা দিয়ে আমার মা রান্না করতেন। আশির দশকে আমার বাবা রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলে মা মিতব্যয়ী কঠিন হস্তে সংসারের হাল ধরেন। আমি তখন অপরিণত বয়সে সংসারের বোঝা কাঁধে নিই। তখন আমার বড় ভাই নারায়ণ মেডিকেলে শেষ বর্ষের ছাত্র। গরু পালন করে দুধ বিক্রি, কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে আরো কত কঠিন কষ্টসাধ্য কাজ আমার মা করেছেন—তার ইয়ত্তা নাই। আমার মায়ের শিক্ষানুরাগ, সহিঞ্চুতা, নিরহংকার মনোভাব আমাদেরকে আজীবন প্রভাবিত করেছে। আশির দশকে শত দারিদ্রতার মাঝেও আমাদের বাসায় নানা ধর্মের, নানা জাতির মানুষের আনাগোনা ছিল, হৃদ্যতা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আমার মায়ের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আমরা লালন করি, ধারণ করবো আজীবন। বয়সের ভারে আমার মা এখন অনেকটা অচল, অসাড়। কিন্তু অবয়বে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা আর কর্মস্পৃহা—এই দ্যুতিতে তিনি এখনো এক মহিয়সী নারী। পেছনে ফেলে আসা সংগ্রামী কর্মবহুল জীবনের বিনিময়ে তিনি আজ আত্মতৃপ্তিতে বিমোহিত এক পার্থিব দেবী—তিনি এখনো বলেন, “জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল, শিক্ষাই হোক পাথেয়।”

কাপ্তাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রিনি চাকমা বলেন, সন্ধ্যা রানী দাশ আমাদের সমাজের একটি জলন্ত উদাহরণ। দারিদ্র্যকে জয় করে তিনি কিভাবে তাঁর ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করেছেন সেটাই আমাদের জন্য উদাহরণ হিসেবে রয়ে থাকবে।