ঢাকা | নভেম্বর ২৭, ২০২৫ - ৭:৩৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

লিজের টাকা আত্মসাৎ থেকে ভুয়া স্বাক্ষর, বহুমুখী অনিয়মে ক্যাশিয়ার ছত্তার

  • আপডেট: Thursday, November 27, 2025 - 5:27 pm

মোহাম্মদ আবুল হাশেম।

বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে তার অপকর্ম। এতে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তাই ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারের দ্রুত অপসারণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর পাশের আলীকদম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বদলি হয়ে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ক্যাশিয়ার পদে যোগদান করেন আব্দুল ছত্তার। চাকরি জীবনের শুরুতে অফিস সহায়ক হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে আওয়ামী দোসরদের ম্যানেজ করে তিনি ক্যাশিয়ার পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম–দুর্নীতিতে। এ ধারাবাহিকতায় তিনি ২০২৪–২৫ অর্থ বছরের জন্য স্থানীয় মো. ফরিদ নামের এক ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিজস্ব জমি লিজ দেন। পরে তিনি এ টাকা রাজস্ব ফান্ডে জমা না করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। শুধু তাই নয়, ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কাছ থেকে জাতীয় কর্মসূচি, ট্রেনিংয়ের সম্মানি, উৎসব ভাতা ও চিত্তবিনোদন ভাতা উত্তোলন করতে উৎকোচ নিয়ে থাকেন। এছাড়া কর্মকর্তা–কর্মচারীরা চিকিৎসাজনিত ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং এলপিসি ইস্যু করার জন্যও দিতে হয় উৎকোচ। ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার বিভিন্ন প্রোগ্রামসহ অফিসিয়াল কাজের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ক্রয় দেখিয়ে ভুয়া বিল–ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে কর্মরত ১১ জন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর সাজ-পোশাক বিতরণের জন্য প্রতিজন কর্মচারীর কাছ থেকে তিনি ২ হাজার টাকা হারে নেন। পরবর্তীতে পোশাক না দিয়ে কর্মচারীদের ১৫ হাজার টাকার স্থলে নগদ ৮ হাজার টাকা হারে বিতরণ করা হয়।

 

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আয়্যা মমতাজ বেগম বলেন, ক্যাশিয়ার আমার কাছ থেকে চাকরি স্থায়ী করণ ও সাজ-পোশাকের জন্য ৪ হাজার টাকা নেন। এদিকে সাজ–পোশাক ভাতা আসার পর বিল উত্তোলনের কথা বলে ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার দুই ধাপে প্রতিজন কর্মচারীর নিকট হতে ১ হাজার ২০০ টাকা নিয়েছেন বলে জানান কুক–মশালচি নুসরাত জাহান সুরমা। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় কর্মরত রত্মা মজুমদার বলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করতে গেলে আমাদের যোগদানপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রতিজন থেকে ৪০–৫০ হাজার টাকা করে নেন ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার।

 

আউটসোর্সিং কর্মচারী আসমাউল হোসনা লুৎফা বলেন, বেতন–ভাতা বরাদ্দের জন্য ঢাকা থেকে চাহিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার ঢাকা যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন। অথচ একই কাজের জন্য তিনি পরপর ২টি টিএ–ডিএ বিলও উত্তোলন করেন বলে শুনেছি। বেতন–ভাতা বরাদ্দ পাওয়ার পর ৬ মাসের বেতন–ভাতা উত্তোলনের জন্য ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার আবারও প্রতিজন কর্মচারীর নিকট থেকে ৭ হাজার টাকা করে নেন। বেতনের সব টাকা যদি ক্যাশিয়ার আর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দিতে হয়, তাহলে চাকরি করে আর কী লাভ।

 

লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মো. আব্দুল ছালাম জানান, তার অবসরোত্তরকালীন সময়ে ক্যাশিয়ার ছত্তার লাম্পগ্রান্ট মঞ্জুরের জন্য ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। ঘুষ না দেওয়ার কারণে দীর্ঘদিন তার ফাইল আটকে রেখেছিলেন। ওয়ার্ড বয় মানিক চন্দ্র দাশ ও অফিস সহায়ক শ্রীমন্ত কুমার দাশ জানান, আমাদের লাম্পগ্রান্ট মঞ্জুরের জন্য ছত্তারকে ঘুষ দিতে হয়েছে।

 

স্বাস্থ্য সহকারী মো. রমিজ উদ্দিন বলেন, আমরা ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩ জন স্বাস্থ্য সহকারী তাদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা (রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন) ভাতা উত্তোলন করতে গেলে আব্দুল ছত্তার অফিস খরচের কথা বলে দুই ধাপে প্রতিজন থেকে ১,০০০ টাকা হারে আদায় করেন। স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের চাকরি খতিয়ান বহি হালনাগাদ করার জন্য প্রাক্তন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ আহমদ স্যারের স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য ঢাকা যেতে হবে বলে প্রতিজন স্বাস্থ্য সহকারীর নিকট হতে ১৫ হাজার টাকা করে নেন। আমরা ৫ জন স্বাস্থ্য সহকারী তাকে ১০ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করি। কিন্তু ঢাকা না গিয়ে চাকরি খতিয়ান বহিতে নিজেই ভুয়া স্বাক্ষর প্রদান করে হালনাগাদ করেন এ ক্যাশিয়ার। আমাদের কর্মচারীদের প্রায় চাকরি বহিতে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভুয়া জাল স্বাক্ষর প্রদান করেছেন। অনেকের এসিআরওতে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কর্মকর্তা–কর্মচারীরা যে কোনো ভাতা ও টিএ–ডিএ বিল উত্তোলন করতে ২০–৩০ শতাংশ হারে উৎকোচ দিতে হয় ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারকে। যারা তার চাহিদামতো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন কিংবা প্রতিবাদ করেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে থাকেন তিনি।

 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত অফিস সহায়ক নুর মোহাম্মদ বলেন, আমি একজন সাসপেন্ডেড কর্মচারী, আইবাস++ এ আমার বেতন আপডেট করার কথা বলে ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার আমার কাছ থেকেও ২ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছেন। এছাড়াও ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও ২০২১ সাল থেকেই তিনি অন্যায়ভাবে ডক্টরস কোয়ার্টারে এক সিট বরাদ্দ দেখিয়ে পুরো কোয়ার্টার ব্যবহার করে আসছেন। তিনি উক্ত কোয়ার্টার বিভিন্ন ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সাব–ভাড়া দিয়েও টাকা আদায় করে থাকেন।

 

স্টোর কিপার নাওফেল জানান, ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার আইবাস++ ডিডিও আইডির অপব্যবহার করে ২০২৩–২৪ এবং ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে প্রায় ১৮ মাস তার এক কক্ষবাসার ভাড়া কর্তন করেননি। স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ১৮ মাসের বাসাভাড়া পরিশোধ করার জন্য বলার পরেও তিনি এখন পর্যন্ত টাকা জমা করেননি।

 

ডিগ্রিখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মাসুদ খান বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে যতগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, ওই সকল কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি’দের বিভিন্ন পরিবহন বিল, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বিল উত্তোলনে এজি (হিসাব রক্ষণ) অফিসের নাম ব্যবহার করে ৩০–৪০ শতাংশ হারে টাকা কর্তন করে রাখতেন আব্দুল ছত্তার।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন নার্স ও মিডওয়াইফ জানান, মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা উত্তোলন, উচ্চতর গ্রেড মঞ্জুরের বকেয়া বিল উত্তোলনেও বড় অঙ্কের উৎকোচ দিতে হয় ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তারকে। সম্প্রতি নবযোগদানকৃত ১৯ জন নার্সের পে–ফিক্সেশনের জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা হারে উৎকোচ গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি হাসপাতালের বিভিন্ন ফলজ গাছের ফলফলাদি (আমড়া, জলপাই, আম, ডাব) কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বিক্রি করে দিয়ে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়াও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক স্বপ্না সরকার এবং স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমানের কাছ থেকে বহিঃবাংলাদেশ ছুটি মঞ্জুরের জন্য ১২ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার। হাসপাতালে কর্মরত ফার্মাসিস্ট অনিক রায়, জুনিয়র মেকানিক জহরিউল ইসলাম, কুক/মশালচি নুসরাত জাহান, বীনা বড়ুয়া এবং নৈশ প্রহরী এছাথোয়াই জানান, ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড আদেশ মঞ্জুরির জন্য তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে উৎকোচ নিয়েছেন আব্দুল ছত্তার। লামা হাসপাতালের কর্মরত সাবেক মেডিকেল অফিসার জেসমিন আক্তার জানান, ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার চিকিৎসকদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন। তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের এসিআর সিভিল সার্জন অফিসে প্রেরণের জন্য প্রতিজন চিকিৎসকের কাছ থেকে তিনি ৫০০ টাকা করে নিয়েছেন। জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) ডা. মো. আব্দুল খালেক জানান, তাহার উচ্চতর গ্রেড মঞ্জুরের পর আইবাস++ পে–ফিক্সেশন করার জন্য ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার তিন ধাপে টাকা নিয়েও অদ্যাবধি কাজটি সম্পন্ন করে দেয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্যাশিয়ার আব্দুল ছত্তার বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারব না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার–পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা নাদিমের মোবাইল ফোনে বক্তব্য নিতে চাইলে তিনি কোনো বক্তব্য না দিয়ে অফিসে দেখা করতে বলেন।