রোহিঙ্গা তাড়াতে মরিয়া জান্তা হারিয়েছে রাখাইন
মো: খায়রুল আলম খান: নজিরবিহীন জাতিগত সংঘাতে রীতিমতো ডুবে আছে মিয়ানমার। এবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে দেশটিতে। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর এই অঞ্চলের জাতিগত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেছে জান্তা কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছরের মাথায় সম্প্রতি দেশটির জান্তা সরকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে দিশেহারা জান্তা বাহিনী। বিদ্রোহী জোটের অন্যতম সদস্য আরাকান আর্মি (এএ); যারা রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে।
রাখাইনে সম্প্রতি আরাকান আর্মির কাছে বিপর্যয়কর পরাজয়ের শিকার হয়েছে জান্তা সেনারা। বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারছে না জান্তা কর্তৃপক্ষ। আর সে কারণেই তারা জাতিগত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, মিয়ানমারের পুরানো রাজধানী শহর ইয়াঙ্গুন ও অন্যতম বড় শহর মান্দালয়সহ জাতিগত বার্মার সংখ্যাগরিষ্ঠ শহরগুলোতে জাতিগত রোহিঙ্গাবিরোধী পোস্টার, ব্যানার ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
এসব পোস্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে জাতিগত রোহিঙ্গাদের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে। রোহিঙ্গা মালিকানাধীন দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোঁরায় না যেতে বলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এইসব শহরে যেসব জাতিগত রোহিঙ্গা বসবাস করেন তাদেরকে তাদের নিজ রাজ্য রাখাইনে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে।
স্থানীয় অধিবাসীদের বরাতে দ্য ইরাবতী বলেছে, গত সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মতো শহরগুলোতে জাতিগত রোহিঙ্গা মালিকানাধীন দোকান ও রেস্তোঁরার সাইনবোর্ডে বা রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট ও বৈদ্যুতিক খুঁটিতে পোস্টার দেখা যাচ্ছে।
ইয়াঙ্গুনে একটি ল্যাম্পপোস্টে লাগানো একটি পোস্টারে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী আরাকান আর্মিকে (এএ) নিন্দা জানাতে রাখাইনের রোহিঙ্গা মালিকানাধীন যেকোনো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলুন।
বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমার। দেশটিতে কমবেশি ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা জাতির বসবাস। এরমধ্যে প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বামার। অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান, কারেন, মন, ওয়া ও রাখাইন বা রোহিঙ্গা উল্লেখযোগ্য। বামাররা বার্মান বা বর্মী নামেও পরিচিত।
আদমশুমারিতে বর্মীদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৮ শতাংশ বলে দেখানো হয়। অন্যান্য জনগোষ্ঠী আরও ৩২ ভাগ। শাসকদল আর সেনাবাহিনীতেও বর্মীদের সংখ্যা ও প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই প্রভাব ধরে রাখার লক্ষ্যেই অন্যান্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ও নিধন চালানো হয়। আর এ দমনপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো থেকেই শুরু জাতিগত সংঘাত।
অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য প্রায়ই জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল বেছে নেয় সংখ্যাগুরু শাসকগোষ্ঠী। মিয়ানমারে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ কমায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিগত বিদ্বেষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। যার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয় এবং ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তূহারা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমারে জাতিগত বিদ্বেষকে রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। শুধু সেনাশাসকরাই নয়, বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও জাতিগত বিদ্বেষের বিস্তার বন্ধ হয়নি। যা বিভিন্ন সময় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে বর্ণ বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এর জন্য সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচিকেও দায়ী করা হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চি’র সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এরপর গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে দমন করা হয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনায় গণতন্ত্রকামীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের জাতিগত যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত যোদ্ধাদের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়। গত তিন বছর ধরেই জান্তা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াই চলছে। তবে সম্প্রতি বিদ্রোহীদের আক্রমণে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বিজিপিসহ সরকারি সব বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এই তুমুল প্রতিরোধের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়া জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট। এই জোট বলছে, তাদের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে জান্তা সরকারের পতন। রাখাইন রাজ্যভিত্তিক আরাকান আর্মি এই থ্রি ব্রাদারহুড জোটের অংশ।
আরাকান আর্মি মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা। কিন্তু এরা ব্যাপক আকারে মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এদের নিয়েই গঠিত হয়েছে আরাকান আর্মি। বর্তমানে মিয়ানমারে এরা সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা রাখাইন রাজ্যে একাধিক জাতিগোষ্ঠীর আরাকানিদের সার্বভৌমত্ব অর্জনের লক্ষ্যে লড়াই করে যাচ্ছে। আরাকান আর্মির মধ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরাও অন্তর্ভুক্ত।
গত বছরের অক্টোবরে উত্তরাঞ্চলের শান ও চিন রাজ্যে অভিযান শুরু করে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা। এতে তারা ব্যাপক সাফল্য পায়। এরপর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাখাইনজুড়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে আরাকান আর্মি। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বহু ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে তারা। এর ফলে এই অঞ্চলের রাখাইন বা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এএ।
বিপরীতে জান্তা কর্তৃপক্ষের চক্ষশূলে পরিণত হয়েছে এএ। আর এ কারণেই পুরো রাখাইন তথা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন শুরু হয়েছে। তবে শহরগুলোতে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এখনও কেউ দায় স্বীকার করেনি।
তবে এই প্রচারণা সরকারসমর্থিত জাতীয়তাবাদী দলগুলোর কাজ বলে মনে করেন স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও বাসিন্দারা। জান্তা কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকেই গণতন্ত্রপন্থি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে দেশের অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন উসকে দেয়ার একটা বড় চেষ্টা দেখা গেছে। আর সেটা জান্তা কর্তৃপক্ষই করছে।