ঢাকা | নভেম্বর ১৯, ২০২৫ - ৮:২০ অপরাহ্ন

শিরোনাম

মাসুদ আর ভালো হলো না; লামায় জমি জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ

  • আপডেট: Wednesday, November 19, 2025 - 7:01 pm

বিশেষ প্রতিবেদক।
মাসুদ আর ভালো হলো না, অবশেষে লামায় জমি জালিয়াতির এক চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে দৈনিক জাগো জনতা-র হাতে। বান্দরবানের লামা উপজেলায় জমি ক্রয়ের নামে সুপরিকল্পিত প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল অনেক আগেই। অভিযোগ অনুযায়ী, খুলনা জেলার মাসুদ পারভেজ ভুয়া পরিচয় ও মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে নিজেকে লামার স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে জমির বায়না দলিল সম্পাদন করেন। ঘটনাটি প্রথমে ব্যক্তিগত লেনদেন মনে হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও বিস্ময়কর তথ্য-এই জালিয়াতিকে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। লামা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এমন প্রতারণা সম্ভব ছিল না বলেই স্থানীয়দের অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জমির বায়না নামা দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় মাসুদ পারভেজ তাঁর পিতা হিসেবে মো. ইউনুস আলী একটি জবানবন্দি জমা দেন। কিন্তু দৈনিক জাগো জনতা সেই জবানবন্দির সূত্র ধরে মো. ইউনুস আলীর হুকুমনামা রেকর্ড উত্তোলন করলে দেখা যায়, রেকর্ডে তাঁর কোনো ছেলের তালিকায় মাসুদ পারভেজ নামে কেউ নেই। ফলে জমির বায়না দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় পিতা উল্লেখ করে যে জবানবন্দি দিয়েছিল তা ভুয়া।

একই সঙ্গে আরেকটি অসঙ্গতি সামনে আসে পিতার বংশপরিচয়ে। হুকুমনামা রেকর্ডে দেখা যায়, মো. ইউনুস আলীর পিতার নাম ইদু শেখ। কিন্তু মাসুদ পারভেজের দেয়া দাদার নাম এহেসান উদ্দিন শেখ।
এছাড়া স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয় দেখানোর জন্য মাসুদ পারভেজ একটি রাজার সনদ (চিপ সার্কেল সনদ) দাখিল করেছিলেন। তবে চিপ সার্কেল অফিস জানায়, ১৭৮৩০ নম্বরের ওই সনদ তাদের রেকর্ডে নেই এবং মাসুদ পারভেজ নামে কাউকে কোনো রাজার সনদ ইস্যু করা হয়নি। ফলে তাঁর স্থানীয় পরিচয় প্রমাণের নথিটিও জাল। ইউনিয়ন পরিষদের জাতীয়তা সনদটিও একইভাবে জাল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সরই ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের রেকর্ডে এমন কোনো সনদ নেই।

ঘটনাটি নিয়ে লিখিত অভিযোগে মোহাং শাহাদাত হোসেন জানান, তিনি লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, উপজেলার ৩০৬ নম্বর ফাইতং মৌজার ৬৩৬ নম্বর হোল্ডিং-এর অধীন জমি ক্রয়ের সময় মো. মাসুদ পারভেজ প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জমির বায়না দলিল সম্পাদন করেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে দলিল নং ১১৮/২০২২ সম্পাদনের সময় মাসুদ পারভেজ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের প্রকৃত পিতা-মাতার নাম গোপন করে অন্যজনকে পিতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। ভুয়া জাতীয়তা সনদ, জাল স্থায়ী বাসিন্দা সনদ ও জাল দলিলপত্র ব্যবহার করে তিনি জমি ক্রয়ের চেষ্টা করেন। প্রশাসনের কাছে তিনি বায়না দলিল বাতিল ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সংবেদনশীল, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ অনুযায়ী, বাহিরাগত কেউ এখানে জমি ক্রয় করতে পারেন না। ভুয়া পরিচয়, জাল সনদ বা মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে জমি ক্রয় করা শুধু প্রতারণা নয়, গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তিনি আরও বলেন, এ ধরনের জালিয়াতিতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করলে তারাও দুর্নীতিতে অংশীদার বলে গণ্য হবে। প্রয়োজনে দলিল বাতিল ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যেতে পারে।

স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এ ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত প্রতারণা নয়, প্রশাসনিক দুর্বলতারও বড় উদাহরণ। বহিরাগতদের ভুয়া পরিচয়ে জমি ক্রয় ভবিষ্যতে সামাজিক ও প্রশাসনিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লামা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এখনো অভিযুক্ত মাসুদ পারভেজকে আশ্রয় দিচ্ছে। বিষয়টি জেনে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভুয়া পরিচয়ে জমি কিনে জালিয়াতিতে জড়ানো একজনকে কেন একটি প্রতিষ্ঠান সেল্টার দেবে?

লামা উপজেলার ইউএনও মো: মঈন উদ্দিন বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। দলিল, পরিচয় ও সকল কাগজপত্র যাচাই চলছে।

আইন বিশ্লেষকদের মতে, দ্রুত তদন্ত শেষ করে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের জালিয়াতি বেড়ে যেতে পারে।

উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম বলেন, খুলনা থেকে এসে বান্দরবানের মতো সংবেদনশীল এলাকায় ভুয়া কাগজপত্রে জমি ক্রয় রাষ্ট্রীয় রেকর্ড জালিয়াতির ঘৃণ্য উদাহরণ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এটি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অফিসার ফয়সাল আজিজ বলেন, তারা কোনো জালিয়াতিকে আশ্রয় দেয় না। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রশাসনের মাধ্যমে জানার পর নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ চলছে।

অভিযুক্ত মাসুদ পারভেজের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।