পুলিশের সমষ্টিগত কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান নয়
জাগোজনতা প্রতিবেদন : রাজধানী ঢাকার ইসলামপুরে পাঁচ বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন কামরুল হাসান। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে গত ১৯ ডিসেম্বর বাসায় ফেরার পথে গুলিস্তান উড়াল সেতুর নিচে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান এ ব্যবসায়ী। তারও সপ্তাহ দুয়েক আগে একই এলাকার এরশাদ মার্কেটের সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় আল আমিন নামে আরো এক ব্যবসায়ীকে।
শুধু কামরুল হাসান কিংবা আল আমিনই নন, ডিসেম্বরই দুর্বৃত্তদের হামলায় ছোট-বড় অন্তত ১৪ ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এটা কেবল ঢাকার চিত্র। সারা দেশে আরো অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে। পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে দেশের ক্রমবর্ধমান অপরাধের এমন চিত্র। প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কেউ কেউ এর সুযোগ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার শঙ্কায়ও রয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে তাদের গড়িমসি রয়েছে। এখনো দৃশ্যমান হয়নি পুলিশের দলগত কর্মপ্রক্রিয়া। এসব কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাহিনীর মধ্যে দ্রুত সমন্বয় এবং টিমওয়ার্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে পুলিশকে।
রাজধানীতে ছুরিকাঘাত ও গুলিবিদ্ধ রোগীর প্রথম গন্তব্য মূলত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। সেখানকার পুলিশ ক্যাম্পের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সদ্যবিদায়ী ডিসেম্বরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুরিকাঘাত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১৭ জনকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১৪ জন ছোট-বড় ব্যবসায়ী। বাকিদের মধ্যে এক শিক্ষার্থী, একজন অটোরিকশাচালক ও একজন চাকরিজীবী। এর বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন তিনজন। তাদের মধ্যে দুজন নিরাপত্তাকর্মী আর বাকি একজন পুলিশ সদস্য।
দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন হুসাইন শুভ। লালবাগের নবাবগঞ্জে তিনি মুরগির ব্যবসা করতেন। নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে গত ২৫ ডিসেম্বর বাসায় ফেরার পথে নবাবগঞ্জ মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে শুভ নিহত হন। এর আগে ৪ ডিসেম্বর গুলিস্তানের পাশে কাপ্তানবাজারেও নাটোর বনজ স্টোরের স্বত্বাধিকারী আল আমিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনাটি কাপ্তানবাজারেই ঘটে। এরপর থেকে ওই বাজারের অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যেও এক ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়লে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য যদি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে তাহলে সেই প্রভাব কিন্তু গোটা দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশকে বসতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। আগে যখন অপরাধ বেড়ে যেত, আমরা তখন পুলিশের তৎপরতা বাড়িয়ে দিতাম। এ তৎপরতার মধ্যে সবার আগে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা হতো। সেখান থেকে অপরাধের আগাম অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যেত, যার ভিত্তিতে এসব অপরাধ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেত।’
কর্মজীবনে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক এ আইজিপি বলেন, ‘এত বড় একটা ধাক্কার (৫ আগস্ট) পর চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল। কিন্তু এখনো পুলিশের কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাহিনীটিকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে সবার আগে তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে তাদের বসতে হবে। জানতে হবে তাদের সমস্যাগুলো। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্রমগুলোকে জনসম্পৃক্ত করা গেলে অনেক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। পাশাপাশি সিনিয়র অফিসারদের নিবিড় তদারকি বাড়াতে হবে। মাঠপর্যায়ে যারা ভালো করছেন পুরস্কৃত করতে হবে তাদের। যারা খারাপ করছেন তাদের করতে হবে তিরস্কার।’
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই মো. ময়নুল ইসলামকে আইজিপি করা হয়। তার কিছুদিনের মধ্যে ডিএমপি কমিশনার করা হয়েছিল মাইনুল হোসেনকে। পরে গত ২০ নভেম্বর দুজনকেই সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন করে আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমকে। একই দিনে ডিএমপির কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে।
পুলিশের শীর্ষ পদে দুই দফা পরিবর্তনের পরও বন্ধ হয়নি ছিনতাই, হত্যা ও অপহরণের মতো অপরাধগুলো। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে সারা দেশে ৪৬৪টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় খুন হয়েছেন ১ হাজার ৩৬১ জন এবং অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২৫৫টি। আগের বছরের একই সময়ে সারা দেশে ৩৯৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। খুন হন ৯৭৬ জন এবং অপহরণের ঘটনা ঘটে ১৭১টি।
আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে সবচেয়ে বেশি ৭৯টি ছিনতাইয়ের ঘটনা পুলিশের হিসাবে নথিভুক্ত হয়েছে। খুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা জেলায়, ৩৩৯টি। খুনের মতো অপরাধের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। সেখানে ওই চার মাসে ২০২টি খুনের অপরাধ সংঘটিত হয়। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৮০টি খুনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে চার মাসে। অপহরণের মতো অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকায়, ৭৬টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যখনই পুলিশের টিমওয়ার্ক এবং সামষ্টিক কার্যক্রম কমে আসে তখনই সমাজে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও অপহরণের মতো অপরাধগুলো বেড়ে যায়। এখন সেটাই হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বপ্রথম পুলিশ সদস্যদের মধ্যে টিমওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। ভালো ও খারাপ দুই ধরনের কাজের জন্যই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নতুন-পুরনোদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় তৈরি করে অপরাধ মোকাবেলায় পুলিশকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘দৃশ্যত এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ পুলিশ বাহিনীতে নিতে দেখা যায়নি যেগুলো তাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে। এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করলে আগামী দিনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান হবে। দেশে এখনো একটা অস্থিতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এটা শুধু পুলিশে নয়, সব ক্ষেত্রেই। গত ১৫ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগবে। পাশাপাশি পুলিশের মধ্যে টিমওয়ার্ক এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।’
সারা দেশেই ছিনতাই, খুন, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর। পুলিশের এ মুখপাত্র বলেন, ‘রাত্রীকালীন টহল বাড়ানো হয়েছে। স্থায়ী তল্লাশিচৌকির পাশাপাশি কৌশলগত অস্থায়ী তল্লাশিচৌকি পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব জায়গা অতিমাত্রায় অপরাধপ্রবণ সেগুলো চিহ্নিত করে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি পুলিশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যেহেতু আর্থিক লেনদেন থাকে, তাই তারা যদি নিরাপত্তাহীনতা থেকে কোনো সহযোগিতা চান, তাহলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’