পাহাড়ের সন্ত্রাস নির্মূলে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প পূনস্থাপন সময়ের দাবী
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আখন্দ
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার উপজাতিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠির একাংশের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (ওরফে সন্তু লারমা) এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদ সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করেন।
প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে সমাধান কল্পে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সংলাপের সূচনা করেছিলেন। তার সময়ের সিনিয়র মন্ত্রী মশিউর রহমানসহ আরো কয়েকজনের সাথে সফল আলোচনা হয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ’র আমলে ৬টি, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের প্রথম আমলে ১৩টি ও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭টি মিলে মোট ২৬টি সংলাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে শুরু থেকেই এ চুক্তির কিছু ধারা নিয়ে প্রবল বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিতর্ক ও সমালোচিত বিষয় হচ্ছে ‘অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার’। শান্তিচুক্তির ঘ-এর ১৭(ক) ধারায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প অপসারণের কথা বলা হয়েছে। জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা ও তাদের সমর্থক সুশীল সমাজ বাহিনী শান্তিচুক্তির এই সকল শর্ত বাস্তবায়িত হয়নি বলে ব্যাপক সমালোচনা করলেও সরকারের দাবি, এই শর্ত আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, চুক্তির শর্তানুযায়ী সরকার ইতোমধ্যেই একটি ব্রিগ্রেডসহ(কাপ্তাই) ২৪১টি নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকার যেসকল নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে, উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সু-কৌশলে সেসকল নিরাপত্তা ক্যাম্পের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৯টি প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন কৌশলে দখল করে নিয়েছে। কোথাও ধর্মীয় স্থাপনা, কোথাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোথাও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এসব নিরাপত্তা ক্যাম্প দখল করে নিয়ে তারা তাদের অস্থায়ী গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে।
শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সেনানিবাসগুলোর ফর্মেশনের কথা সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। এ চুক্তির ঘ খ-এর ১৭(ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি, তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞাও দেয়া নেই। অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন, জোন, সাবজোন, কোম্পানি স্থাপনা?, নাকি সেনা আউট পোস্ট বোঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাটাও রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। এছাড়া এখানে শুধু সেনা ক্যাম্পের কথাও বলা হয়নি। সেনা ও আনসার ভিডিপি ক্যাম্পের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৪টি ব্রিগেডের মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ব্রিগেডে ৫ ব্যাটালিয়ন করে (৩*৫=১৫) সৈন্য রয়েছে, গুইমারায় রয়েছে ৩ ব্যাটালিয়ন। সব মিলিয়ে ১৮ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। (বিজিবি আলাদা)। একটি ব্যাটালিয়নে গড়ে ৭০০ করে সৈন্য ধরলে ১৮টি ব্যাটালিয়নে ১২-১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফর্মেশন অনুযায়ী ৩-৫টি ব্যাটিলিয়ন নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪টি ব্রিগেড থাকলে সেখানে ১২-২০ ব্যাটালিয়ন সৈন্য থাকতেই হবে। ব্যাটালিয়নগুলো আবার গড়ে ওঠে কতকগুলো সাবজোনের সমন্বয়ে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোন, সাবজোনগুলো কোথায়, কীভাবে অবস্থান করবে? শান্তিচুক্তির ঘ খ-এর ১৭(ক) ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে।’
দিনরাতের এই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে যেকোনো ভারতীয় পণ্যবাহী পরিবহণ যদি হামলার শিকার হয় তাহলে তা আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনামে ওঠে আসবে। প্রায় একই ধরণের চ্যালেঞ্জ থেগামুখ ও ঘুনধুম স্থলবন্দরের জন্যও প্রযোজ্য। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উক্ত আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র ও বাণিজ্যিক রুটগুলোর নিরাপত্তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাক্যাম্প বিন্যাসে নতুন ভাবনা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক চক্রান্ত
বাংলাদেশী ও ভারতীয় পার্বত্য এলাকার ওপর ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিশনারি ও এনজিওর মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্টান বানানো হয়েছে। মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে রয়েছে রেকর্ডসংখ্যক ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানদের সংখ্যাও একেবারে ফেলনা নয়। আন্তর্জাতিক শক্তি চায় বাংলাদেশী ও ভারতীয় পার্বত্য এলাকা নিয়ে এক বা একাধিক স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জন্ম দিতে। তাই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই খ্রিষ্টান নিয়ন্ত্রিত দাতাগোষ্ঠী প্রকাশ্যে চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌত অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তারা সাহায্য প্রদানে অত্যন্ত আগ্রহী। বিগত ২৬ বছরে তাদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। এ শান্তিচুক্তি বেলফোর ডিক্লারেশনের মতো তাৎপর্যপূর্ণ। বেলফোর ডিক্লারেশন যেমন আরবের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম দিয়েছিল তেমনি এ শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের বুকে নতুন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের জন্মও দিতে পারে। এখানে আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও দাতাগোষ্ঠী এ চুক্তিকে স্বাগত জানালেও এ পর্যন্ত কোনো মুসলিম রাষ্ট্র এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেনি। যার কারণে এই অপশক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য মরণ ব্যাধি হিসেবে কাজ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যাক্ত করেন।
শান্তিচুক্তি ৪ খন্ডের বিভক্ত। ক খন্ডে ৪টি, খ খন্ডে ৩৫টি, গ খন্ডে ১৪টি, এবং ঘ খন্ডে ১৯টি মিলে সর্বমোট ৭২টি ধারার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর জন্য শুধৃমাত্র শর্ত ছিলো দুটি, চুক্তির (ঘ) খন্ডে অনুচ্ছেদ ১৩ এবং অনুচ্ছেদ১৪-এ বলা হয়েছে…
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সকল সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়া।
(খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সকল সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
এই দুটি শর্তের কোন একটা শর্ত জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আদৌ পুরণ করছে কি???
প্রশ্ন এখানেই থেকে যায়।
ধারণা করা হয় সর্বমোট ১৯৪৬ জন সদস্য ৭৬১টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেও এটা ছিলো নামে মাত্র লোক দেখানো কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বৌধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) র মিড়িয়ায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে জানা যায় পূনরায় অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার কথা।
সেই থেকে অধ্যবদি পাহাড়ে খুন ও অপহরণের দরজা পুণরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। এই ধরণের হত্যকাণ্ডের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈধতা হারিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
তাই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও সকল হত্যাযজ্ঞ নিরসনে পাহাড়ের রক্তস্রোতের অবসান ঘটাতে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প পূণস্থাপন করা আজ পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সমসাময়িক গণদাবীতে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের সকল গণমানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার পাহাড়ের প্রত্যাহারকৃত সকল সেনাবাহিনীর ক্যাম্প পূণস্থাপন করবে এটাই পার্বত্যবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য গভেষক।
তথ্যসূত্র: পার্বত্য তথ্যকোষ-মোঃ আতিকুর রহমান।