ঢাকা | অক্টোবর ৬, ২০২৫ - ৪:২৮ অপরাহ্ন

শিরোনাম

ন্যায়বিচারের নামে প্রতারণা, পার্বত্যাঞ্চলে যৌন সহিংসতার রাজনীতি

  • আপডেট: Thursday, September 25, 2025 - 1:38 pm

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতি আঘাত।

ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার মতো জঘন্য অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়বোধ; তবু সাম্প্রতিককালে পার্বত্যাঞ্চলের কিছু সন্ত্রাসী ও উগ্র গোষ্ঠী ছোট ঘটনার নেপথ্যে এটিকে প্রহসনের মতো ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে সাধারণ মানুষকে উসকে দিচ্ছে। ফলে নিরপেক্ষ বিচারের দাবি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মাঝখানে একটি ভাঙাচোরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার সীমানা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।

এসব গোষ্ঠীর জন্য ধর্ষণ কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশলের একটি উপাদান; যেখানে তারা আন্দোলন, অবরোধ ও প্রভাব বিস্তারের আড়ালে অর্থ সংগ্রহ ও ক্ষমতা অর্জন করে।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে অর্থসংগ্রহ একটি নিয়মিত অনুষ্ঠানীতে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের নামে বিভিন্ন দপ্তর থেকে লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করা, ‘প্রতিবাদী ফি’ আকারে অর্থ দাবি করা এবং সামাজিক দোলাচলে তা কাজে লাগানো—এসব কৌশলই তাদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যায়ের জন্য চাহিদা ও প্রতিবাদের অনুভূতিই সহজেই অপব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়। তাদের উদ্দেশ্য কেবল বিচারের দাবি নয়; বরং অসামাজিক উপায়ে অর্থ সংগ্রহ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, এটা তাদের প্রকৃত লক্ষ্য। এই অর্থই তাদের সশস্ত্র যোগান, প্ররোচনামূলক কার্যক্রম ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম চালায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক বাস্তবতায় এক অদ্ভুত বৈপরীত্য বারবার চোখে পড়ে। যখন কোনো উপজাতি কর্তৃক ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তখন স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থাকে। তারা এসব ঘটনার ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন তোলে না, বরং অনেক সময় গোপনে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে ভুক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যায় পুনরায় অপরাধ করতে।

কিন্তু বিপরীতে, সামান্য কোনো বিষয় যদি বাঙালিদের সঙ্গে জড়িত হয়, তখনই এই গোষ্ঠীগুলো সেটিকে বড় করে প্রচার করে। কখনো মিছিল, কখনো অবরোধ, আবার কখনো গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে উত্তেজনা ছড়ায়। এর মধ্য দিয়ে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক ও আর্থিক ফায়দা লুটে। এমনকি অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার জন্য দায় বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা সমাজে অন্যায় ও অবিচারকে আরও গভীর করে তোলে।

ন্যায়বিচার সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। অপরাধী সে উপজাতি হোক বা বাঙালি—আইনের চোখে তার পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরাধটাই মূল বিষয়। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে এ ধরনের দ্বিমুখী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি, যাতে কোনো গোষ্ঠী আর নীরবতা কিংবা অপপ্রচার দিয়ে অপরাধ আড়াল করতে না পারে।

খাগড়াছড়ি সদর, সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় শয়ন শীল নামের একজনকে অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তদন্তকারীরা তৎপরভাবে কাজ চালাচ্ছে, এমনকি সেনাবাহিনীর সহায়তাও নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্রুত গ্রেপ্তার ও তদন্তের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে যারা ঘটনাকে রাজনৈতিক আঙ্গিকে মোড়াবার চেষ্টা করছে, তারা কি সত্যিকারের ন্যায়চিন্তার ধারক নাকি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক-আর্থিক এজেন্ডা সামলানোর চেষ্টা করছে—এ প্রশ্ন সবার সামনে দাঁড়ায়।

ঘটনা সম্পর্কে তাড়াহুড়ো করে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবাপন্ন প্রতিবাদ ডাকা সংবেদনশীল পরিস্থিতি আরও জটিল করে। কেউ যদি বিচার চান না, বরং এই ঘটনার আশ্রয়ে রাজনৈতিক অর্জন ও অর্থ উপার্জন করতে চান, তাহলে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথই বাধাগ্রস্ত হয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চাওয়া ও ভুক্তভোগীর পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা—এই দুটি কথা একে অপরের পরিপূরক; একটির অমান্য অন্যটিকে ভেস্তে দিতে পারে। ফলে সমাজকে সতর্ক থাকতে হবে যে কেউ এই নৃশংস ঘটনাকে রাজনৈতিক টুল বানিয়ে মিথ্যা উত্তেজনা সৃষ্টি না করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হওয়া উচিত দ্রুত, পেশাদার ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনা করা যাতে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো সহজ না হয়। তদন্তে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে প্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষ্য নিরীক্ষা ও ফরেনসিক মুষ্টাক্ষ পরীক্ষা নিশ্চিত করা প্রাথমিক শর্ত। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সঠিক তথ্য দিয়ে আতঙ্ক ও গুজব প্রতিরোধ করতে হবে। যেখানে জনগণ নির্ভরযোগ্য তথ্য ও সুষ্ঠু বিচার পাবে, সেখানে অপপ্রচারের খোরাক কমে যাবে এবং কল্পিত ষড়যন্ত্রগুলো প্রভাব হারাবে।
ব্লগার, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ও স্থানীয় নেতাদেরও দায়িত্ব আছে—তারা সংবেদনশীল ঘটনাগুলো রিপোর্ট করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করবেন, অপূর্ণ তথ্য ছড়াবেন না এবং বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তা কেবল মামলার স্বচ্ছতা নষ্ট করে না, বরং বিচারের সম্ভাব্য ফলাফলকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই জনমত গঠন করার দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

পার্বত্য অঞ্চলের সামাজিক ও আর্থিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো পুনরায় তাদের অবৈধ অর্থ সংগ্রহের কৌশল ব্যবহার করে। তারা কখনো মুক্তিপণ দাবি করে, কখনো ‘প্রতিবাদী’ নাম ধরে অর্থ আদায় করে এবং কখনো অবরোধ দ্বারা সাধারণ পরিবহন ও অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে জনজীবনকে ভোগান্তিতে ফেলে দেয়। এভাবে তারা স্থানীয় লোকদের জীবিকা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবাকে দুর্বল করতে চেষ্টা করে থাকে, যা শেষপর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের ক্ষতি করে। লাভবান হয় দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের চক্রগুলো।

ভুক্তভোগীর চিকিৎসা, মানসিক পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা—এগুলোই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। ধর্ষণের শিকারকে সম্মান ও সহানুভূতিতে সেবা দেওয়া না হলে রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রয়োজনে তারা শুধুই একটি বাক্সে পরিণত হবে। তাই রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় স্তরে স্বাস্থ্যসেবা, আইনি সহায়তা ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করা অনিবার্য। একই সঙ্গে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন, যাতে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসে এবং সামাজিক আস্থা পুনরুদ্ধার হয়।
আইন, সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি একযোগে কাজ করে, তাহলে অপপ্রচারকারী চক্রগুলোর আর্থিক ও রাজনৈতিক ধারক ক্ষীণ করে ফেলা সম্ভব। স্থানীয় নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা তদন্ত প্রক্রিয়ার পাশে দাঁড়ালে ঘটনার প্রতি পণ্যের স্বচ্ছতা বাড়ে এবং মিথ্যা আর প্ররোচনামূলক অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সীমিত হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি রক্ষা পাবে।

সবশেষে—সমাজের প্রত্যেক সদস্যের কাছে আহ্বান: সংযম ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখুন। নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও আইনি পথে ন্যায়বিচার দাবি করুন। যদি আমরা সকলে একসাথে—আইনপ্রণীত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সমাজ ও দেশবাসী—এই সমস্যার মোকাবিলা করি, তাহলে কেবল অপরাধীর বিচার হবে না; তাদের পেছনের আর্থিক ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্কও দুর্বল হয়ে পড়বে। তখনই পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রকৃত শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের আলোর মধ্যে জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে।