নরকের ট্রেন
এক মুহূর্তের জন্য নড়ার উপায় নেই স্পেশাল ট্রেনটির গার্ড কামরার সামনে থেকে; এ ট্রেনেরই গার্ড মোমিনুল হক। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হানাদার হায়নাগুলো সারা কুমিল্লা রেলস্টেশন চত্বরজুড়ে গিজগিজ করছে। অঘুম আর ক্লান্তিতে এদের প্রত্যেকের চোখ দুটো লাল, ভীষণাকৃতির মুখ ও পোশাকের কারণে ওদের হিংস্র যে কোনো জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ক্ষিপ্রদৃষ্টি তাদের এমন যেন, যেখানে চোখ পড়ছে সেই জায়গাটা আগুনের আঁচে পুড়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির কারণে গার্ড মোমিনুলের বুকের ভেতর যে অস্থিরতা আগে থেকেই ছিল তা আরও বেড়ে গেছে। সময় খুব দ্রুত গড়াচ্ছে সামনের দিকে। যেন বোঝা না যায় তেমন সংযত ভাব নিয়ে মোমিনুল চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। পারতপক্ষে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সৈনিক অথবা সহকর্মী কারও চোখের ওপর চোখ ফেলছেন না তিনি। এ সময়ে তার মনোযোগ নষ্ট হোক তা তিনি চান না।
আর যে কারণে গার্ড মোমিনুল চিন্তিত, সেই বিষয়টি ভয়ংকর স্পর্শকাতর এবং বিপজ্জনক। বললেই সেটি হয়ে যায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এর চেয়ে কঠিন এবং মৃত্যুঝুঁকির কাজ আর নেই। এ ট্রেনের গার্ড কামরার ডগ বাক্সে লুকিয়ে আছে মতিন। তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না মতির অবস্থান। ওর ওপর অর্পিত কাজ ঠিকমতো সমাধার জন্য তাকে হায়নাদের অগোচরে ট্রেনে বহন করে নিয়ে যাওয়া গার্ড মোমিনুলের দায়িত্ব। যে কোনো মূল্যে এ কাজ সমাধা করতে হবে। জান থাক আর যাক, ট্রেন ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত আর কোনো চিন্তা বা কাজ নেই।
আগেই জানা ছিল, আজ সারা কুমিল্লা স্টেশনজুড়ে পাক সেনারা গিজগিজ করবে। অন্যদিনের তুলনায় আরও বেশি সৈন্য নিয়ে আসা হয়েছে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে। কামানসহ ভারি অস্ত্র-গোলাবারুদ আর নতুন সৈন্যরা একটু আগে হুকুম পেয়ে মোট দশটি কামরার প্রত্যেকটিতে লাইন দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছে। এএসএম রকিবুল সিগন্যাল রুম থেকে বের হয়ে গার্ড মোমিনুলের সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা তার মলিন, বিষণ্ন। চুলগুলো উশকোখুশকো। একটু টোকা দিলেই ভেঙে পড়বে শরীর। নিুস্বরে মোমিনুলকে বলল রকিবুল,
-ছেলেটা কাইল অনেক রাইতে বাসায় আইসা দেখা কইরা গেল। কিছু কইল না। তার মা আর আমারে সালাম কইরা কেবল কইল, বানাসুয়া কী কামে যেন ওরা আসছে সবাই।
গার্ড সাহেব সবই জানেন। মুখে কিছু না বলে আওয়াজ করলেন, হু।
তারপর অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-লাইন ক্লিয়ার দেবেন কখন? কিছু বলছে ওরা? হুকুম পাইছেন?
-যাইবেনই তো। গেলেই তো গেলেন। যেজন্য আসছি, মেজর সাব আপনেরে যাইতে কইল টেলিফোনে।
গার্ড সাহেব মনে মনে শঙ্কিত হলেন। এখন বাজে রাত দশটা দশ। যে কোনো সময় রওয়ানা হওয়ার হুকুম হবে। এ সময় ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার আগে নিজের এ কামরার সামনে থেকে সরে যাওয়ার একটু ইচ্ছাও তার নেই। একটু এদিক-সেদিক হলে অপারেশন ভন্ডুল হয়ে যাবে আর মৃত্যু তো অবধারিত। এ যুদ্ধে হেরে যাওয়া বলে কোনো শব্দ নেই। রকিবুলের কথা শেষ হতে না হতেই মেজর বোখারির সেন্ট্রি এসে সামনে দাঁড়াল। রকিবুল আস্তে করে বলল,
-কোনো চিন্তা কইরেন না, আপনি যান, আমি আছি।
রকিবুল গার্ড সাহেবকে আশ্বস্ত করায় এক লহমার জন্য তিনি ভাবলেন, রকিবুল কি জানে! তা না হলে সে দরজার সামনে দাঁড়াতে চাইবে কেন? অনুচ্চ স্বরে বললেন,
-ঠিক আছে। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বেন না।
পাক অফিসার মেজর বোখারি ইতোমধ্যে কুমিল্লার অবরুদ্ধ সাধারণ মানুষের কাছে নৃশংস খুনি হিসাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গতকাল সকালেও সে রুটিন টহলে বের হয়ে রাজগঞ্জ বাজারের সামনে যাকে পেয়েছে তাকে এক রশিতে বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরেছে। গার্ড মোমিনুল বোখারির কক্ষে ঢুকে সালাম দিতেই ভীষণ উত্তেজিত চেহারা তার ফেটে পড়ল। টেবিল থাপড়ে সে ধমকে উঠল,
-মতি কাঁহা? ও সালে বাস্টার্ড, শুয়োর কা বাচ্চা, আভি তক্ হামারা সাপ্লাই নেহি দিয়া। দেখো হ্যায় উশকো। জানতে হ্যায় ও কাঁহা?
বয়স্ক আর সৌম্য দর্শন অভিজ্ঞ বলে গার্ড মোমিনুলকে বোখারি সম্মান না দেখালেও অসম্মান করে না। ইংরেজি, উর্দু ভালো জানেন। কথা বলতে সুবিধা আর দোভাষীর কাজ হয় তাকে দিয়ে। গত সাত মাসে রেলের এ মানুষটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সে। বোখারির প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন মোমিনুল,
-ম্যায় নেহি দেখা উশকো।
আবার হাত নেড়ে বোখারি কর্কশ স্বরে বলল,
-হামারা হোল ট্রুপস আর রেডি টু স্টার্ট। হোয়াট দ্য হেল আই উইল ডু নাও? সান অব এ বিচ্..
উত্তেজিত বোখারি উঠে দাঁড়াল। বাস্তবতা এই, বাঙালি এসব ছেলে তাদের খাবার, পানীয় বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাপ্লাই না দিলে জোর করে নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের আর কোনো উপায় ছিল না। মতি নামের ছেলেটি এদের খাবার রসদ সাপ্লাই দেয়। আজ জরুরি অপারেশনে যাচ্ছে ওরা। এ সময় খাবার রসদ না পেলে মহা সমস্যা। সংগত কারণেই বোখারির মেজাজ খারাপ হয়েছে। গার্ড মোমিনুল নরম স্বরে বললেন,
-বাহার যা কে ম্যায় ঢুন্ডো?
-নেহি নেহি। যানে কা ওয়াক্ত হো গিয়া। আপ যাইয়ে। গেট রেডি। আওর শুনিয়ে, যো কুছ ভি হো না হো, ট্রেন চলে গা। অনলি ফকিরহাট স্টেশন পে দো মিনিট কে লিয়ে রুখনা পড়েগা। নেহি তো ট্রেন কসবা স্টেশন মে হল্ট করেগা। ঠিক হ্যায়। গো এন্ গেট রেডি।
বাতাসে বিরক্তির হাত নেড়ে মোমিনুলকে ফিরে যেতে বলল বোখারি। গার্ড সাহেব মাথা নেড়ে বোখারির কথায় সায় দিয়ে ওর কক্ষ থেকে বের হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে গার্ড রুমের দিকে সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে ফিরতে লাগলেন। যতবার বোখারি তলব করবে ততবার একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরে। হট হেডেড খুনি ছাড়া আর কিছুই তো নয় সে!
এ বোখারি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কুমিল্লা শহরে এত মানুষ খুন করেছে যেজন্য তার নাম শুনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গতকালও সে রাজগঞ্জের মোড়ে এক রশিতে একদল মানুষকে বেঁধে ব্রাশফায়ার করে ড্রেনে ফেলে রেখে জিপ হাঁকিয়ে চলে গেছে। কুমিল্লা রেলস্টেশন কসবা থেকে ফকিরহাট সীমান্তজুড়ে যুদ্ধপরিচালনার জন্য অন্যতম ঘাঁটি হওয়ার পর বোখারি এর দায়িত্ব পায়। সে গার্ড মোমিনুলকে সম্মান না করলেও অসম্মান করে না। গার্ড সাহেব ইংরেজি এবং উর্দু ভালো জানেন। কাজের সময় বাঙালি কর্মচারী, লেবার এবং মুক্তি বলে যাদের ওরা ধরে আনে তাদের সঙ্গে দোভাষী হিসাবে তাকে ব্যবহার করে ওরা। দরকারেই যে মোমিনুল ওদের কাছে গ্রাহ্য এ কথা সবাই জানে। না হলে কোনো বাঙালিই এ হায়নাদের হিসাবের মধ্যে পড়ে না।
নিজের কামরার সামনে মোমিনুল হক ফিরে দেখলেন সহকারী স্টেশনমাস্টার রকিবুল তার কামরার সামনে এমনভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে যে একটি মাছিও তার ফাঁক গলে কামরার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। হক সাহেব রকিবুলের পিঠে নরম হাত রেখে কৃতজ্ঞতা জানালেন। আল্লাহ হাফেজ বলে বকিবুল বিদায় নিতে গিয়ে কী বলতে চাইল বলল না। দ্রুত নিজের কামরার দিকে চলে গেল।
দুই.
রাত বারোটা তিন মিনিটে সিগন্যাল পড়ল ট্রেন ছাড়ার।
গার্ড মোমিনুল হক তার ডিউটি রোস্টার, গার্ড বুকের সেদিনের পাতায় লিখলেন,
ডেট-০৬. ০৬ ১৯৭১, ৩৬ আপ ০০০৩ আওয়ার। ডিপারচার-কুমিল্লা টু কসবা। সই করলেন। তারপর যা এ খাতায় লেখার কথা না তাই লিখলেন ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে-ফ্রি ড ম লং লিভ বাংলাদেশ।
গার্ড বুক বন্ধ করে কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে এক বুক শ্বাস নিলেন মোমিনুল। হুইসেলটা মুখে পুরে বিসমিল্লাহ বলে মুখের ওপরে বাম হাতটা রেখে ট্রেন ছাড়ার জন্য ফুঁ দিলেন। তারপর বাম হাতে দরজার হ্যান্ডলে ধরে ডান হাতে বরাবরের মতো নীল নিশানটা বাতাসে উড়ালেন। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। নিজের স্টেশনটাকে ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েকবার দেখে নিলেন। কে জানে, আর দেখতে পাবেন কিনা! সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের মুখ। এক ঝটকায় চোখ ঘুরিয়ে চেহারাগুলো সরিয়ে দিলেন মনেরে আয়না থেকে। দেখলেন, চলতি ট্রেনের অদূরে প্লাটফর্মে নিজের কক্ষের দরজার কাছ থেকে ডান হাত তুলে তাকে সালাম জানাল রকিবুল। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক সহকর্মী গার্ড আবদুল ওহাব। তিনিও হাত তুলে তাকে বিদায় জানালেন।
স্পিড তোলার মুখে স্পেশাল ট্রেনটা চলতে চলতে শাসনগাছা রেলক্রসিং পার হয়ে ধীরগতি হতে জতে থেমে গেল। মোমিনুল অনুমান করলেন, নিজের কামরা থেকে ওয়াকিটকিতে রোখারি ইঞ্জিনের ড্রাইভারকে অথবা ইঞ্জিনে থাকা সেন্ট্রিকে কোনো কারণে থামতে বলে থাকতে পারে। মোমিনুল হকের কক্ষেও ইমার্জেন্সি ট্রেন থামানোর জন্য একটি হুইল আছে। যেটা প্রয়োজনে ডান দিকে ঘুরালে দুই বগির মাঝখানের কাপলিঙ্ক খুলে ট্রেনের চাকার মধ্যে প্রচণ্ড বাতাসের চাপ সৃষ্টি করে ট্রেনের গতি শ্লথ করে দেয়। ইঞ্জিনের ড্রাইভার স্পিড মিটারে তা টের পেয়ে ব্রেক চাপে।
মোমিনুল ভাবতে বাধ্য হলেন, তাকে তো কিছু বলা হলো না, তাহলে ট্রেন থামল কেন?
একটা দম বন্ধ করা অস্বস্তি গার্ডের চেতনাকে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দিল। কী ব্যাপার?
শঙ্কিত মন নিয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলেন। ডগ বাক্সের ভেতরে চাপা গলায় মতিকে প্রস্তুত থাকতে বলে অপেক্ষা করতে লাগলেন হুকুমের।
এ সময়ে একটি ম্যাচের কাঠিতে ট্রেনটা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ডগ বাক্সের ভেতর থেকে তারের জালিতে তিন টোকা দিয়ে জানাল মতি। ডেটোনেটরে আগুন দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। গার্ড সাহেব হুকুম দিলেই ডগ বাক্সের ভেতর থেকে বিদ্যুতের গতিতে বের হয়ে মতি ওপাশের জানালা দিয়ে গলিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে যাবে। মোমিনুল দেখলেন, জুনিয়র অফিসার পদের একজন পাক সেনা দৌড়ে তার কামরার দিকে আসছে। পেছনে মুখ না ফিরিয়ে মতিকে দরজার কাছ থেকে বললেন,
-তৈরি থাকিস্। হারামজাদা এইদিকে আসতেছে!
সৈনিকটি দৌড়ে এসে হক সাহেবের দরজার কাছে নিচে দাঁড়িয়ে গেল। সেখান থেকেই উচ্চস্বরে বলল,
-স্যার আপকো বোলা, ফকিরহাট স্টেশন পে রুখনা নেহি পড়েগা। সমঝে?
উত্তরে মোমিনুল মাথা নাড়তেই সৈনিকটি দৌড়ে আবার নিজের কামরায় ফিরে গেল।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হক সাহেব আবার নীল নিশান উড়াতেই ট্রেন চলতে শুরু করল। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে হুইসেল দিয়ে কয়লার ইঞ্জিন গতি তুলে আউটার পার হতেই মতিকে ডগ বাক্স থেকে বের হতে বললেন তিনি। মতি তার পায়ে হাত ছুঁইয়ে কোনো কথা না বলে দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে জানালায় পা রেখে ছাদের ওপরে অদৃশ্য হলো। অপেক্ষা করবে সময়ের।
গার্ড মোমিনুল আল্লাহর নাম স্মরণ করে প্রস্তুত হলেন। ঘড়ি দেখলেন কবজি উলটিয়ে। জানেন, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন চলে ঘড়ি ধরে, চোখের ইশারায়।
বাইরে উঁকি দিয়ে চারপাশ দেখে নিলেন। দেখলেন, কয়লার ইঞ্জিনের লম্বা গলা দিয়ে গলগল করে কালোধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দানবটা বানাসুয়া ব্রিজের ওপরে উঠে যাচ্ছে। ট্রেনটা ব্রিজে উঠলেই গুমগুম করে ভারি শব্দ হবে। ব্রিজে ইঞ্জিনটা উঠতে শুরু করতেই হক সাহেব দরজার বাইরে হাত বাড়িয়ে নীল বাতিটা দুলিয়ে দিলেন। কথা ছিল এমনই। ওটা সংকেত। সংকেত পেয়ে ছাদের ওপরে মতি বুকে পিঠে গোলা বাঁধা দুই হাতে গ্রেনেড নিয়ে বোখারির কামরার জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
গ্রেনেড ফাটার শব্দ আর মরণ চিৎকার শুনতে শুনতে গার্ড মোমিনুল নিজের কামরার ডেটোনেটর চার্জ করেই চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলেন দরজার বাইরে অতল অন্ধকারে।
মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারানোর আগে মোমিনুল নিজের কামরাটাকে তুলার মতো আগুনের গোলা হয়ে আকাশে উড়তে দেখলেন। একই সময়ে বানাসুয়া ব্রিজের নিচে মুক্তিযোদ্ধাদের পাতা বোমার বিস্ফোরণে দুটো পিলার ধসে পড়ল। তাতে গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো সেজদার ভঙ্গিতে ইঞ্জিনটা ঝুলে পড়ল নদীর ওপর। আর প্রকৃতি থেকে সেসময় বাতাসের ইন্ধন পেয়ে পুরো ট্রেনটা আগুনের খাদ্য হতে খুব বেশি সময় নিল না।
এদিকে ব্রিজের ওপরে থেমে যাওয়া ট্রেনের ভেতর থেকে মৃত্যুভয়ে ভীত পাক সেনারা অন্ধকারে নদীর ঢালে দিগ্বিদিক ছুটে যারা বাঁচতে চাইল তারা সামনে এবং পেছন দিক থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম গুলির মুখে পড়ল।
আর নদীর উত্তর পারে বানাসুয়া ব্রিজের নিচে গাঙের আইলে সেতুটির পতন এবং সব যজ্ঞটি দেখছিলেন মেলাঘর ক্যাম্পের গেরিলা কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়দার। মাথার ওপরে ব্রিজের লোহার রেলিংয়ের ফাঁকে আটকে যাওয়া ট্রেনটি তখন পাটকাঠির মতো জ্বলছে। ভেসে আসছে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আর মরণ আর্তনাদ।
একটা ফোঁপানো কান্নার আওয়াজ শুনে ক্যাপ্টেন হায়দার পেছন ফিরে দেখলেন, গার্ড মোমিনুল হক সাহেবের ছেলে মাহিনকে। কমান্ডারকে ওর দিকে ফিরে তাকাতে দেখে মাহিনের কান্নার চোখ-মুখ পাথরে রূপ নিয়েছে। ক্যাপ্টেন ওর মাথায় হাত রাখলেন। মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু পরক্ষণেই জ্ঞান হারানো পতনোন্মুখ মাহিনকে দুই হাতে ঝাপটে তুলে ধরে পরম আদরে বুকে তুলে নিলেন।
এখানে আর কেউ না জানলেও তিনি জানেন, কেন মাহিন জ্ঞান হারাল। ফলে গেরিলা অধিনায়কের চোখ দুটোও আর শুকনো থাকে না কিছুতেই।