ঢাকা | অক্টোবর ২৯, ২০২৫ - ৭:৩০ অপরাহ্ন

শিরোনাম

দক্ষ হাতই গড়ে তোলে সমৃদ্ধ জাতি: বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার গল্প

  • আপডেট: Wednesday, October 29, 2025 - 3:37 pm
মো. মামুন হাসান।। ভোরের সূর্যের মতো উদীয়মান এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মানবসভ্যতা। এটি এমন এক যুগ যেখানে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মেলবন্ধন নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিচ্ছে। এই যুগের নাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এখানে বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র মানুষের নয়, মেশিনেরও আছে। মানুষ ও প্রযুক্তির এই সহাবস্থানের যুগে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন এমন শিক্ষা যা বইয়ের পাতা থেকে বের হয়ে বাস্তব জীবনের কাজে লাগে। সেই শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা।

এক সময় আমরা ভাবতাম, সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি হলো উচ্চশিক্ষা। কিন্তু আজকের পৃথিবী আমাদের শিখিয়েছে, জ্ঞান তখনই শক্তি যখন তা প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তব পরিবর্তন আনে। এখন কেবল তথ্য জানলেই হবে না, জানতে হবে কীভাবে তা কাজে লাগানো যায়। দক্ষতা আজকের যুগের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিশ্বের তথ্য-প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক গবেষণা প্রমাণ করছে, নতুন পেশার প্রায় অর্ধেক ২০৩০ সালের মধ্যে বদলে যাবে। অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স অনেক কাজের ধরন পরিবর্তন করবে, তবে একই সঙ্গে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলবে। তাই বলা যায়, “দক্ষ হাতই গড়ে তোলে সমৃদ্ধ জাতি।”

বাংলাদেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী এখন এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের প্রায় ৮০০টি সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কারিগরি শিক্ষার বিস্তারে নিরলসভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত এবং সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল ইঙ্গিত।

কারিগরি শিক্ষা কেবল কর্মসংস্থানের পথ নয়, এটি আত্মনির্ভরতার শক্তিশালী হাতিয়ার। একজন কারিগরি শিক্ষিত তরুণ শুধুই চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং চাকরি সৃষ্টিকারী। আজকের তরুণরা নিজ উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা শুরু করছে, নতুন প্রযুক্তি ও সমাধান উদ্ভাবন করছে। কেউ ইলেকট্রিক সার্ভিস খুলছে, কেউ ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে দক্ষতা অর্জন করে আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করছে, কেউ আবার হসপিটালিটি খাতে উদ্যোক্তা হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার তরুণ কাজ করছে, যাদের অনেকেই কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই বুঝে গেছে যে কারিগরি শিক্ষাই টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। জার্মানিতে ডুয়াল সিস্টেম শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কারিগরি শিক্ষিত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা ইঞ্জিনিয়ারের সমান। সিঙ্গাপুরও তার টেকনিক্যাল এডুকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা দ্রুত বাস্তব রূপ নিচ্ছে। সরকার বাস্তবায়ন করছে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ও স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যার মাধ্যমে লাখো তরুণ বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিটি জেলায় গড়ে উঠছে আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র, ল্যাবরেটরি ও কর্মশালা। দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। এতে তারা আত্মনির্ভর হচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিতেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ আনছে।

কারিগরি শিক্ষা শুধু হাতে কাজ শেখায় না, এটি শেখায় চিন্তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এটি শেখায় সমস্যার সমাধান খুঁজতে, উদ্ভাবনী হতে এবং নিজের পরিশ্রমকে মর্যাদা দিতে। একজন কারিগরি শিক্ষার্থী জানে, দক্ষতা মানে স্বাধীনতা। কারণ দক্ষ মানুষ কখনও পরিস্থিতির দাস নয়, বরং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও কার্যকরী চিন্তাশীলতা অর্জন করে। তারা শিখতে শিখে, সমস্যার সঠিক মূল্যায়ন করতে শিখে এবং কার্যকর সমাধান উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। কারিগরি শিক্ষার্থীরা দায়িত্বশীল, উদ্যমী এবং প্রগতিশীল। তারা নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতিকে দ্রুত আয়ত্তে আনে এবং প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সাফল্যের সুযোগে রূপান্তর করতে পারে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। মানুষকে এখন শিখতে হবে কীভাবে মেশিনের সঙ্গে কাজ করতে হয়, কীভাবে প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে হয়। কারিগরি শিক্ষা এই মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করে। এটি শেখায় শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও সৃজনশীলতা যা ভবিষ্যতের কর্মজীবনের অপরিহার্য গুণ।

ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে এমন এক দেশ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ও পলিটেকনিকের সার্টিফিকেট সমান মর্যাদার প্রতীক হবে। একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন ওয়েল্ডার, একজন টেকনিশিয়ান বা একজন হসপিটালিটি এক্সপার্ট সবাই একসঙ্গে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। কারণ উন্নত জাতি গড়ে ওঠে তখনই যখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ জায়গায় দক্ষ, সৎ ও সৃজনশীল হয়।

বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। যদি এই তরুণ প্রজন্ম কারিগরি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়, তারা শুধু নিজেদের ভাগ্য নয়, গোটা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। তারা হবে সেই আলোকবর্তিকা যারা অন্ধকার থেকে আলোয় দেশকে নিয়ে যাবে।কারিগরি শিক্ষা তাই শুধু কর্মজীবনের পাঠ নয়, এটি জীবনদর্শনের এক জাগ্রত শক্তি যা শেখায়, “দক্ষ হাতই গড়ে তোলে সমৃদ্ধ জাতি।”

কারিগরি শিক্ষা আমাদের শেখায় যে সীমাবদ্ধতা শুধু মানসিক। যদি আমরা সাহসী হই, কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাই, নতুন প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করি এবং নিজের দক্ষতাকে ধারাবাহিকভাবে উন্নত করি, তবে কোনো চ্যালেঞ্জই আমাদের আটকে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশে তরুণদের এই সম্ভাবনা এবং উদ্যম দেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।

এটি শুধু একটি শিক্ষার গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের প্রগতির গল্প। প্রতিটি দক্ষ হাত এই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি নতুন উদ্ভাবন দেশের ভবিষ্যতকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে। কারিগরি শিক্ষার আলোয় আলোকিত তরুণরা হবে দেশের অগ্রযাত্রার মূল শক্তি।

  • লেখক: ইনস্ট্রাক্টর (টেক) ও বিভাগীয় প্রধান
  • ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
  • সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।