ঢাকা | সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪ - ১২:৩২ অপরাহ্ন

শিরোনাম

দক্ষিন কোরিয়া অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের অংশীদার হতে চায়

  • আপডেট: Tuesday, August 29, 2023 - 5:46 pm

মো: খায়রুল আলম খান : স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নীত হতে প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। আর এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া।

ঢাকায় কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক এমন কথা বলেছেন।

১৯৭৩ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরে ৭০-এর দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত উন্নয়নে সিউলের অবদান অনস্বীকার্য। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া।

পার্ক ইয়ং-সিক বলেন, “ভুলতা-আড়াইহাজার-বাঞ্ছারামপুর সড়কে মেঘনা সেতু প্রকল্প (আর-২০৩) ও মেঘনা নদী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে (বিএসএমএসএন) শোধিত পানি সরবরাহের প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যৌথ পিপিপি প্ল্যাটফর্ম সভার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রকল্পগুলো কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে।”

মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন।

উৎপাদন খাতকে আরও গতিশীল করতে দুটি নীতি পরিবর্তনের ওপর জোর দেন তিনি।

কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের দূতাবাস, কোরিয়া ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সি (কোটরা), ও কোরিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (কেবিসিসিআই) যৌথভাবে “কোরিয়া-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা-শেয়ারিং ডেভেলপমেন্ট এক্সপেরিয়েন্স অ্যান্ড এক্সপ্লোরিং অপারচুনিটিজ” শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে।

বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি ও সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য করা দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এটি বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি ওডিএ (অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট) দেশ যারা ঋণগ্রহীতা থেকে দাতা দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।

দেশটি জাহাজ নির্মাণ, সেমিকন্ডাক্টর ও মোবাইল ফোন উৎপাদনসহ বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পে বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিধর।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া আজকের কোরিয়া সম্ভব হতো না।”

বাংলাদেশকে সহায়তা প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, “বন্ধুদের সহায়তায়, কোরিয়া তার অর্থনীতিকে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তাই কোরিয়া নিজের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চায়।”

১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

কোরিয়ান উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে এসে পোশাক কারখানা স্থাপন করেছেন, যাদের অনেকেই এখনও সক্রিয়।

১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কোরিয়ান ডেইউ কর্পোরেশন শ্রমিকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণসহ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে অবদান রেখেছিল, যা এখন দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য।

প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের দেশ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৩০ জন নতুন নিয়োগ করা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়। শিল্পের বিকাশের জন্য তারা নিজস্ব পোশাক ব্যবসা শুরু করলে ডেইউ কর্পোরেশন বাংলাদেশ ছেড়ে যায়।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “তারপর থেকে, দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভিন্নভাবে বিকাশ লাভ করেছে, যা উভয় অর্থনীতির জন্য উপকৃত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “প্রথমত, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ২০২২ সালে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কোরিয়া ও বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির আলোচনা করছে। ইপিএ পৌঁছালে, পারস্পরিক সুবিধাসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।”

“দ্বিতীয়ত, এছাড়া সঞ্চিত পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশে কোরিয়ার বিনিয়োগ পঞ্চম বৃহত্তম।”

সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হলো- স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অটোমোবাইল, মোবাইল ফোন এবং ইলেকট্রনিক্সে উত্পাদন শিল্পের বৃদ্ধি।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম দেশ-নির্দিষ্ট বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, কেইপিজেড কোরিয়া-বাংলাদেশ ব্যবসায়িক বন্ধনের প্রতীক।”

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নত দেশের দিকে ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।”

“এটি একইসঙ্গে দুর্দান্ত সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ইতিবাচক।

২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত বিশ্ব অর্থনীতির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ৩২টি দেশের মধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি রয়েছে বাংলাদেশের।

পার্ক ইয়ং-সিক বলেন, “আরেকটি ভাল খবর হলো বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।”

তিনি বলেন, “এলডিসি উন্নীত হওয়া আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে একটি ইতিবাচক সংকেত দেবে। যা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশী পুঁজি আকর্ষণ করা সহজ করে তুলবে।”

তিনি বলেন, “এলডিসি উন্নীতের সনদ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ প্রস্তুতির প্রয়োজন।”

“২০২৬ সালে এলডিসি উন্নীতের সনদ গ্রহণের আগে, বাংলাদেশ সরকারকে ভিত্তি সুসংহত ও উত্পাদন খাতের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে।”

এর জন্য কিছু নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। এ বিষয়ে তিনি দুটি নীতি পরিবর্তনের ওপর জোর দেন।

“প্রথমত, বর্তমানে ৫০% এরও বেশি মোবাইল ফোন পাচার করা হচ্ছে। এই চোরাচালানের ফলে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপক কর ক্ষতির শিকার হতে হয়।”

“বাংলাদেশে মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চোরাচালানের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা আরও বিনিয়োগে বাধা দেয়।”

তার মতে, “চোরাচালান করা মোবাইল ফোনের পিন নিবন্ধন টেলিকম প্রতিষ্ঠানের কাছে সীমাবদ্ধ করলে এই কারণে হওয়া ক্ষতি কমানো যেতে পারে।”

“দ্বিতীয়ত, প্রায় আমদানি করা প্রায় ৮৫% গাড়ি পুনর্নির্মাণ করা হয়, যেখানে বাংলাদেশে ১৫% এরও কম নতুন গাড়ি আমদানি বা উত্পাদিত হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায়, বাংলাদেশ আমদানিকৃত কাঁচামাল ও অটো যন্ত্রাংশের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে।”

রাষ্ট্রদূত বলেন, “এই দুটি উপাদান প্রতিযোগিতাকে লোকসানের দিকে ঠেলে দেয় ও বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া এবং অন্যান্য দেশ এরইমধ্যে ব্যবহৃত বা পুনর্নির্মাণ করা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করার নীতি বাস্তবায়ন করছে।”

তিনি বলেন, “সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করলে, বিদেশী পুঁজি আসবে। এর মাধ্যমে দেশেই নতুন গাড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এই নীতির ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনও হ্রাস পাবে।”

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে গত এক দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের তিনগুণ বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “আমার বিশ্বাস এলডিসিতে উত্তরণে বাংলাদেশ সব সঙ্কট কাটিয়ে উঠবে ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।”