ঢাকা | সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ - ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

তবু কেন মশা মরে না?

  • আপডেট: Saturday, September 30, 2023 - 6:17 pm

ডেঙ্গু এ বছর স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ভয়াবহতা ছড়াচ্ছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ১৯ দিনে যে সংখ্যক প্রাণহানি হয়েছে, অতীতে শুধু একটি বছর ছাড়া পুরো বছরেও এত মৃত্যু হয়নি। এবার প্রাদুর্ভাবের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে ডেঙ্গু। যদিও কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাওয়ার দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। মশা নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।

কোটি কোটি টাকা খরচ আর এত এত কাজের নমুনা হচ্ছে মশার কামড়ে চলতি মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ২৫৩ জন। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এ বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৪৬ জন। যার মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৭৪ জন। আক্রান্ত ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৫ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার জন রাজধানীতে বসবাসকারী।

আক্রান্ত ও মৃত্যুর দীর্ঘ এই তালিকা যেন কর্তৃপক্ষের কাছে নিতান্তই সংখ্যামাত্র। এত মৃত্যুর পরও মন্ত্রী-মেয়ররা একে অপরের ওপর দায় চাপাতে আর নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে ব্যস্ত। সবাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জোরালো দাবি প্রচার করে চলেছেন।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘মশা না কমলে ডেঙ্গু রোগীও কমবে না। তাই মশা নিধন করতে হবে। মশা নিধন করলেই রোগী কমবে, মৃত্যু কমবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পত্রিকায়, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। মাইকিংও করছি। কাজটি সিটি করপোরেশনের, তবুও আমরা করছি।’

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দিচ্ছে না। এর জন্য মশার বিস্তার রোধের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা দিন-রাত কাজ করছেন। মেয়র মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। বিশাল কর্মীবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ও সংসদ সদস্যরাও। এই কর্মযজ্ঞের পেছনে ১৬১ কোটি টাকা খরচ করার পরিকল্পনাও রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের। এত কাজের পরও মশা মারার আসল কাজটা না হওয়ায় প্রতিদিনই দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি মনজুর আহমেদ চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ডেঙ্গুতে এত মানুষের মৃত্যুর পেছনে সিটি করপোরেশনের দায় রয়েছে। এখন তো মহামারিই চলছে বলা যায়। সরকারের উচিত ছিল ‘হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা। এত ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পরও মশক নিধনে যে পদক্ষেপ দরকার তা নেওয়া হচ্ছে না। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অ্যাডাল্ট (পূর্ণবয়স্ক) মশা মারার। কিন্তু তা না করে লার্ভিসাইডিং করার কথা বলা হচ্ছে। সেই কাজও ঠিকমতো করছে না।

মনজুর আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, মশক নিধন খাতে দুর্নীতি হয়। যারা করে, তারা ভাবে এক সময় তো এমনিই মশা কমে যাবে, তখন দাবি করা যাবেÑ আমরা মশা মেরেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রতিনিধিকে মেয়র বানাতে হবে, যাদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকবে।

প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, উত্তরের (ডিএনসিসি) মেয়র এখন কোথায়? প্রতিদিন মানুষ মরছে, এই অবস্থায় বিদেশে কিসের কনফারেন্স। উনার উচিত ছিল এই অবস্থায় মানুষের পাশে থাকা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ সাইফুর রহমান বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। মশক নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে ডেঙ্গু এই অবস্থায় আসত না। মশক নিধনে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা আছে কি না সেটা আগে দেখতে হবে। কতদিনের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণ করবে তাও ঠিক করতে হবে।

তিনি বলেন, মশক নিধনে জনগণের হাতে কেউ কোনো অস্ত্র দেয়নি, নেই কোনো ট্রেনিং। কিন্তু বলা হচ্ছে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কীভাবে এগিয়ে আসবেÑ সবার আগে এটা ঠিক করতে হবে। তা না হলে বছর বছর শুধু টাকাই খরচ হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। এই মুহূর্তে সারা দেশ নিয়ে একটি মশা কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেওয়া দরকার।

ভুক্তভোগীদের কথা

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী মানুষের অনেকেই মনে করে, ডেঙ্গু ঠেকাতে হলে মশা মারতে মুখে মুখে ‘কামান দাগানো’ বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। সব সংস্থা সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে না নামলে ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয়।

মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন বলেন, ওষুধে মশা মরে এটা আর কেউ বিশ্বাস করে না। মশার ওষুধের নামে সরকারি টাকা ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে জমে থাকা পানিতে মশা জন্মায়। এই পানি পরিষ্কার করলে তো আর ওষুধ ছিটাতে হয় না। রামপুরার হাজীবাগের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকায় দুই মাসেও কোনো মশার ওষুধ দিতে দেখিনি।

ডেমরার বাসিন্দা হাসিনা পারভীন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য শুনি কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু মশা তো মরে না। আমাদের এখানে মাসে এক দিনও মশার ওষুধ দিতে দেখিনি।

মশা নিধনের দায়িত্ব কার

দেশে মশক নিধনে মূলত কাজ করে থাকে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কাজে সিটি করপোরেশনের জনবল, বাজেট ও সরঞ্জাম থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের তা নেই। গ্রামাঞ্চলে মশার কামড় থেকে রেহাই পেতে নিজ উদ্যোগে কেনা মশারি, স্প্রে ও কয়েলই ভরসা।

রাজধানীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ছাড়াও মশা মারার জন্য ‘মশক নিবারণী দপ্তর’ নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লালবাগে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানটি একপ্রকার অকার্যকর হয়ে আছে। ফলে ঢাকার মশা মারার সব দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনেরই।

এ বছর ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে ১৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ডিএসসিসি প্রায় ৪৭ কোটি এবং ডিএনসিসি ১১৪ কোটি টাকা খরচ করবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সকালে লার্ভিসাইড (মশার লার্ভা ধ্বংসের তরল ওষুধ) এবং বিকালে অ্যাডাল্টিসাইড (উড়ন্ত মশা মারতে ধোঁয়া) প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর বাইরেও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার দাবিও করেছেন তারা।

মশা নিয়ন্ত্রণে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু এখন আর কোনো মৌসুমি রোগ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সারা বছরই এটা থেকে যাচ্ছে। যার ফলে এবার বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে ডিএসসিসি। এ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মতবিনিময় সভা, মশক কর্মীদের প্রশিক্ষণ, জনসম্পৃক্তকরণ, মাইকিং, কীটনাশক প্রয়োগ, চিরুনি অভিযান, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর বাড়িতে বিশেষ অভিযান, লাল চিহ্নিত ওয়ার্ডে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো, নিজস্ব ও অন্যান্য স্থাপনায় মশক নিধনে চিরুনি অভিযান, ছাদবাগানের পরিচর্যা এবং কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি মজুদ করা।

ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ঢাকায় যে রোগীর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখাচ্ছে, এর বেশিরভাগ ঢাকার বাইরের রোগী, যারা ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণের রোগী অনেক কমে এসেছে। আমাদের মশক নিধন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। মেয়র নিজে মাঠপর্যায়ে যাচ্ছেন। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আমরা কাজ করছি। আমাদের কার্যক্রমে ঢাকায় রোগীর সংখ্যা আরও কমে আসবে।

তিনি জানান, দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলররা সকাল-বিকাল মশক নিধন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। সংসদ সদস্যরাও বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধনে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো ছাড়াও যেখানে লার্ভা পাচ্ছি, সেখানেই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। মানুষকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে কার্টুন বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে আলাদা কমিটি করা হয়েছে।

২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা জরিমানা

ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ অভিযান শুরু করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। গতকাল পর্যন্ত এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় মোট ২ কোটি ৮৭ লাখ ৭ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে সংস্থা দুটি। তা ছাড়া একজনকে জেলও দেওয়া হয়।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ জুন থেকে করপোরেশন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ হাজার ৪০৪টি বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়েছে। এ সময় ৬৯৪টি বাড়ি, স্থাপনা ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ৬১৮টি বাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়ার অভিযোগে ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ জুলাই থেকে বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি শুরু হয়। গত সোমবার পর্যন্ত ৬ লাখ ১২ হাজার ৭২টি সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭৬টিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। নিয়মিত মামলার সংখ্যা ১০২। ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা হয়েছে ৩৭৬টি। ৪ হাজার ৭৩টি নোটিস দেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সড়ক, ড্রেন ও স্থাপনায় লার্ভিসাইডিং করা হয়েছে। পানির চৌবাচ্চা, দইয়ের হাঁড়ি, চিপসের প্যাকেট ও নির্মাণাধীন বাড়ির ভেতরে সবচেয়ে বেশি মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত আরও ৩ হাজার

সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ২৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৪৯ জন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ১৭৪ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ সময় আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১০ হাজার ১০২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ৮১৪ জন এবং অন্যান্য জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ হাজার ২৮৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

অন্যান্য শাখাঃ