ঢাকা | সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫ - ৭:৩৭ অপরাহ্ন

শিরোনাম

ডাকসুতে জয় শিবিরের জন্য অগ্নিপরীক্ষা: ছাত্রদলের জন্য সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি

  • আপডেট: Friday, September 12, 2025 - 12:06 pm

ইমামুল হক শামীম।। ডাকসু নির্বাচনের পর জাকসু নির্বাচনও হয়ে গেলো। ডাকসুর ফল ইতোমধ্যে সবার জানা। জাকসুর ফল অপেক্ষমাণ।

ডাকসু নির্বাচনের ফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সবখানে বোদ্ধা-অবোদ্ধা সব মহলের বিশ্লেষণ চলছে।

আমার বিশ্লেষণের প্রথমে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ফল বিশ্লেষণ করতে চাই। তারপর বিজয়ী শিবির ও তাদের অনুসারীদের আচরণ নিয়ে কিছু কথা বলবো।

এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে হেরেছে, এটা দৃশ্যমান বাস্তবতা। আমার দৃষ্টিতে ইন রিয়ালিটি ছাত্রদল হারলেও তার অর্জনও একেবারে কম নয়।

আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সেইটা আবার কীভাবে? বলছি তাহলে। কিন্তু তার আগে একটা উদাহরণ দেই। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক একজন নেতা। এসএম হলে আমার অনুজ। নাম ইয়াসিন। এখন থেকে ১৭/১৮ বছর আগে আমি যখন হলে থাকি তখন সে হল কমিটির একজন নেতা। ২০০৭ সালে হল ছাড়ার পর ২০১৪/১৫ সালের দিকে তার সঙ্গে দেখা। রাজনীতির আলাপচারিতার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম বিয়েথা করেছো? ওর জবাব ছিলো, ভাই ছাত্রদল করি, কখন জেলে চলে যেতে হয় নাকি গুম। কোন মেয়ের বাপ এই ঝুঁকি নিয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আমার মনে হয় হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ ছাত্রদল নেতা-কর্মীর নিয়তি ছিল এরকমটাই। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও করুণ।

জেল-জুলুম, নির্যাতনে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদলের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড নেমে আসে প্রায় শুন্যের কোটায়। নতুন রিক্রুটও কম। ভরসা পুরনো রিক্রুটরাই। এমন পরিস্থিতিতে আচমকা এক রক্তক্ষয়ী জনঅভ্যুত্থানে ২৪’র ৫ আগষ্ট হাসিনা মসনদ ছেড়ে পালিয়ে গেলে ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসগুলোতে কিছুটা পা ফেলার সুযোগ পায় ছাত্রদল। কিন্তু ক্যাম্পাসগুলোতে বিরোধীদের পরিকল্পিত ছাত্ররাজনীতি বিরোধী অবস্থানের কারণে মুক্ত বাংলাদেশের ক্যাম্পাসেও মুক্তভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে বারবার বাধাগ্রস্ত হয় সংগঠনটি। তার ওপর মাঠ পর্যায়ে মূলদল বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণেও তরুন প্রজন্মের কাছে গ্রহনযোগ্য উপায়ে পৌঁছাতেও বেগ পেতে হয় তাদের। আর সিন্ডিকেটেড অপপ্রচারতো ছিলই।

এমন বৈরি পরিবেশে ডাকসুর তফসিল ঘোষণা হলে গণতান্ত্রিক রীতি মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মাত্র কয়েকটি সপ্তাহ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌছানোর সুযোগ পায় তাদের নেতা-কর্মীরা। সেখানেও ছিল না কোঅরডিনেটেড কোন ইফোর্ট। ছিল নানান সীমাবদ্ধতা।

এরপরও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি-জিএস প্রার্থী প্রত্যেকে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ভোট পেয়েছে। আমি মনে করি এটাও কম অর্জন নয়। এবং এটাও মনে করি এই সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থীর সবাইকে ছাত্রদলের নেতৃত্ব না চিনলেও এরা জাতীয়তাবাদী আদর্শের সমর্থক। যাদেরকে পেতে মিছিল মিটিং এ নিতে হয়নি। তারা সাচ্ছা সমর্থক। এখন কাজ এই সংখ্যাটি বৃদ্ধি করা।

এবার আসি ছাত্র শিবিরের ভোটের হার বিশ্লেষণে। ভিপি-জিএস সহ অধিকাংশ প্রার্থী জিতেছে শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে। ভিপি ছাড়া অন্য পদে প্যানেলটির ভোট প্রাপ্তির হার প্রায় ৩০ শতাংশ। ১০ থেকে ১১ হাজারের মধ্যে। আমার অনুমান এর মধ্যে শিবিরের ৪/৫হাজার রিজার্ভ ভোট বাদ দিলে বাকি ভোটের কিছু অংশ ছাত্র লীগ সমর্থকদের, আর কিছু অংশ ফ্লোটিং। যদিও বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী কাস্টিং ভোটের ৪০ শতাংশই ফ্লোটিং ভোট। এই ফ্লোটিং ভোটটাই প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদলের নেগেটিভ ভোটিং। যা তারা পাইতে পারতো ভালো সাংগঠনিক তৎপরতা এবং যুগোপযোগী বয়ান তৈরি করে ছাত্রদের মন জয় করতে পারলে। কিন্তু তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতায় ফ্লোটিং ভোটের বড় অংশ যায় অপেক্ষাকৃত শৃঙ্খলা ও প্রচারণায় এগিয়ে থাকা শিবিরের বাক্সে।

এরপরও ছাত্রদলের পক্ষে ছাত্রদের মন জয়ের সুযোগ কী শেষ হয়ে গেছে? বোধ করি, না। সুযোগ ছাত্রদলের সামনে এসেছে মাত্র। অন্যদিকে মূল চ্যালেঞ্জ শুরু হলো শিবিরের জন্য। তাদেরকে এখন প্রতিদিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই পরীক্ষায় শিবিরের প্রধান প্রতিপক্ষ অন্য কোন ছাত্র সংগঠন নয়। প্রতিপক্ষ তাদের মূল নেতৃত্বের বাইরের কিছুটা অশিক্ষিত ও সভ্য সংস্কৃতি বিহীন সমর্থক বাহিনী ও সোশ্যাল মিডিয়া। দৃশ্যতঃ এই সোশ্যাল মিডিয়া যদিও এখন শিবিরের অন্যতম শক্তির জায়গা। কিন্তু দলটির কলেজ ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যে ভাষায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিপক্ষকে যেভাবে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে তা অব্যাহত থাকলে যে কোন সময় তাদের বিরুদ্ধে নেপালের মতো দাঁড়াতে জেন-জি এবং সামনে ম্যাচিউরড হতে যাওয়া জেনারেশন-আলফা দুবার ভাববে না।

এটাতো বললাম মেধাবী শিবিরের কথা। অকথ্য ভাষা ও হুমকি-ধামকিতে পিছিয়ে থাকে না শিবিরের অবিভাবকেরাও। একটা শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র সংসদ ডাকসুতে জিতে তাদের অনেকে যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্ট করছে তাতে সাদিক-ফরহাদরা চাইলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন কতদিন তারা ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। একটা সতর্কবার্তা দিয়ে রাখি, সাধারণ শিক্ষার্থী লাগবে না, এমনকি ছাত্রদলের মানসুরাকে অসম্মান করে গালি দিলেও ছাত্রসমাজ কোন একদিন দাঁড়িয়ে যেতে পারে শিবিরের বিরুদ্ধে। তাই শিবিরের প্রতি আহ্বান দলের নেতা-কর্মীদের শুধু ধর্ম আর একাডেমিক প্রশিক্ষণ নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ব্যবহারের প্রশিক্ষনও দিন।

আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে বলবো শিবিরকে যে শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিকে ২০১৯ সালে শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে হল সংসদের ভিপি বানিয়েছিলো, সেই ইমি এবার ডাকসুতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সাকুল্যে ভোট পেয়েছে ৬৮টি। এটা কিন্তু দৃষ্টান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কাউকে অন্ধভাবে ধারণ করে রাখে না।

এজন্য বলছি, ডাকসু একদিকে শিবিরের জন্য অগ্নিপরীক্ষা অন্যদিকে ছাত্রদলের জন্য অবারিত সুযোগের হাতছানি। শুধু নতুন করে রিসেট বাটনে ক্লিক করে পুরনো জঞ্জাল ক্লিন করে একটা ফ্রেস স্টার্ট দিতে হবে তাদের। এজন্য সামনের দিনগুলোতে ছাত্রদলকে ইতিবাচক ও শিক্ষার্থীবান্ধব বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তাহলে সংগঠনটি অচিরেই ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করতে পারবে। বৈপ্লবিক বলছি এই কারণে যে ছাত্রদলের জন্ম বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এটি ৭৫’র ৭ই নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ধারাবাহিক ফল। এরপর ৮১ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাত্রদলকে মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। যার ফল পেয়েছে ৯০’র ডাকসুতে।

সোনালি এই অতীত ফিরিয়ে আনতে হলে ২৪’র বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে ছাত্রসমাজ কী চায় তা নিয়ে নিবিড় রিসার্চ করতে হবে দলটিকে। প্রয়োজনে রিসার্চ উইং তৈরি করে SWOT এনালাইসিস করে নিজেদের স্ট্রেংথ, উইকনেস, অপরচুনিটি ও থ্রেটস বের করতে হবে। এরপর এর আলোকে নিজেদের প্রস্তুতের পাশাপাশি সঠিক কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। নেতা-কর্মীদের ট্রেইনড করতে হবে। কারণ ট্রেইনিং ইজ ইনভেস্টমেন্ট। ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া বিজনেস আর মুনাফা কোনটাই হয় না।

মাই ম্যান পলিটিক্স ছেড়ে শহীদ জিয়ার আদর্শের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করতে হবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মানে কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মানে হলো ভৌগোলিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক থাকা।

একাত্তরের পক্ষে বিপক্ষের বিভাজনভিত্তিক আওয়ামী ন্যারেটিভের পুনর্বাসন না করে ৭১ এবং ২৪ এর ন্যায়, সাম্য ও সুবিচারের চেতনাকে ধারণ করে বয়ান তৈরি করতে হবে।

ভিউজীবীদের কথায় প্ররোচিত হয়ে প্রতিপক্ষ সংগঠনের সমালোচনায় বেশি সময় ব্যয় করার চেয়ে, নিজের কর্ম, কর্মপরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের দিকে ফোকাস থাকতে হবে। এবং এর পক্ষে স্ট্রং বয়ান তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়।

ছাত্রদলকে বিএনপির দিকে না তাকিয়ে মাইক্রোলেভেলে কর্মসূচি প্রনয়ন ও সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে।

মনে রাখতে হবে বর্তমান প্রজন্ম অতীত নয় বর্তমানকে বিবেচনা করে ভবিষ্যতের চিত্র আঁকে। এরা অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল। রিয়ালিটিতে বিশ্বাস করে। নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা-মায়ের কথায়ও নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে না। কারণ সে বিশ্বাস রাখে ডেটায়। সিদ্ধান্ত গ্রহনে কনফিউজড হলে সহায়তা নেয় এআই’র। তাই তাদের সামনে ইতিহাস নয় রিয়ালিটি শো করতে হবে। সেজন্য তাদের কানেক্ট করে এমন নেতৃত্ব বাছাইয়ের পাশাপাশি কর্মসূচিও গ্রহণ করতে হবে। এই যাত্রায় হামিম-মায়েদদের মতো পজিটিভ জেশ্চারের আরও আরও নেতৃত্ব খোঁজে বের করতে হবে। তাহলেই কেবল জয় করা যাবে তরুন প্রজন্মের হৃদয়।

সবশেষে ডাকসু নির্বাচন কভার করতে গিয়ে স্ট্রোকে মারা যাওয়া সাংবাদিক ও জাকসু নির্বাচনে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে মারা যাওয়া শিক্ষিকার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখকঃ সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।