টঙ্গীতে ইজতেমা ময়দানে তাবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ৩
জাগোজনতা অনলাইন : টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারিদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান বলেন, মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত তিনজন মারা গেছেন।
সংঘর্ষে নিহতরা হলেন, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু এলাকার বাচ্চু মিয়া (৭০) ও ঢাকার দক্ষিণখানের বেড়াইদ এলাকার বেলাল হোসেন (৫৫)। অপরজন হলেন মাওলানা সাদের অনুসারী বগুড়ার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম (৬৫)।
আহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আ. রউফ (৫৫), মজিবুর রহমান (৫৮), আ. হান্নান (৬০), হান্নান (৫৫), জহুরুল ইসলাম (৩৮), আরিফ (৩৪), ফয়সাল (২৮), তরিকুল (৪২), সাহেদ (৪৪), উকিল মিয়া (৫৮), পান্ত (৫৫), খোরশেদ আলম (৫০), বেলাল (৩৪), আবু বক্কর (৫৯), আরিফুল ইসলাম (৫০), আনোয়ার (৫০), আনোয়ার (২৬), আনোয়ার (৭৬), ফোরকান আহমেদ (৩৫), দেলোয়ার হোসেন (৫৬), ফয়সাল (১৮), আলাউদ্দিন (৩৫), রিশাদ (৩০), নুরুল হাকিম (৩০), সালাউদ্দিন ভূঁইয়া (৫০), সাদ (২১) এবং সিয়াম ( ২৪)।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, টঙ্গীতে সংঘর্ষের মধ্যে আহত বেলালকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ভোর সাড়ে ৫টায় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া আহত অবস্থায় ১১ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি হাবিব ইস্কান্দার বলেন, মঙ্গলবার ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করছিলেন মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারিরা। পরে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারিরা তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রিজসহ বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে থাকেন।
এ সময় মাঠের ভেতর থেকে জুবায়ের অনুসারীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। জবাবে সাদের অনুসারীরাও পাল্টা হামলা চালায়।
একপর্যায়ে সাদপন্থীরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ, সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
পরে সংঘর্ষে হতাহতদের টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ওসি আরও বলেন, এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে।
তাবলীগ জামাতের সাদপন্থী মুরুব্বী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলেন, “২০ ডিসেম্বর টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আমাদের জোড় ইজতেমা শুরুর হওয়ার কথা ছিল। মাঠ প্রস্তুতির জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ মাঠের আশেপাশে রাস্তার পাশে এসে অবস্থান নিচ্ছিলেন।
“আমাদের এ প্রস্তুতি দেখে জোবায়ের পন্থীরা বাইরে থেকে গাড়ি ভরে গিয়ে আমাদের লোকজনের উপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং আমাদের লোকজন ইজতেমা ময়দানে ঢুকে পড়ে। পরে সেখানে দুই গ্রুপের মধ্যে আবার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।”
তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষ দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভি এবং বাংলাদেশের কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের বিরোধের শুরু ২০১৯ সালে।
আগে এক মঞ্চ থেকে একবারই বিশ্ব ইজতেমা হলেও মতভেদের কারণে দুই পক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাঝে কোভিড মহামারীর কারণে ইজতেমা দুই বছর বন্ধ থাকে। ২০২২ সাল থেকে ফের ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বের আয়োজনে।
সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও টঙ্গীর তুরাগ তীরে দুই পর্বে হবে তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে বড় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা।
আগামী বছর প্রথম পর্বে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ইজতেমায় অংশ নিবেন ‘জুবায়েরপন্থিরা’ এবং দ্বিতীয় পর্বে ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি অংশ নিবেন ‘সাদপন্থিরা’।
গত ১৭ নভেম্বর এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রথম পর্বের আয়োজকরা তাদের আয়োজন শেষে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত বিশ্ব ইজতেমার মাঠ প্রস্তুতি সংক্রান্ত কমিটিকে ৪ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টার মধ্যে ইজতেমার মাঠ বুঝিয়ে দেবেন।
দ্বিতীয় পর্বের আয়োজনকারীরা একই দিন বিকালে কমিটির কাছ থেকে ইজতেমার মাঠ বুঝে নেবেন। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তারা কমিটির কাছে মাঠ হস্তান্তর করবেন।
তবে সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে তাদের মধ্যে চলমান বিবাদ নতুন রূপ পায়।
গত ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন’ থেকে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করাসহ ৯ দফা দাবি জানান জুবায়েরপন্থিরা, যারা নিজেদের ‘শুরায়ে নিজাম’ পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এরপর ১২ নভেম্বর কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠে সাদপন্থিদের প্রবেশের সুযোগ দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা অচলের হুঁশিয়ারি দেন জুবায়েরপন্থিরা।
এমন উত্তেজনার মধ্যেই দুই পক্ষের ‘সমঝোতার ভিত্তিতে’ গত ১৫ নভেম্বর ঢাকার কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের ব্যাপক জমায়েত দেখা যায়।
‘চার সপ্তাহ থাকবেন জুবায়েরপন্থিরা আর দুই সপ্তাহ থাকবেন সাদপন্থিরা’ এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সেদিন কাকরাইল মসজিদে দুই সপ্তাহের অবস্থান শুরু করেন সাদপন্থিরা।
এর মধ্যে গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালন করেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা।
এরপর ইজতেমা মাঠে ২০ ডিসেম্বর থেকে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন দিল্লির মাওলানা সাদের অনুসারীরা।
তবে সাদের অনুসারীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।
সমাবেশের পর দাবি আদায়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর স্মারকলিপিও দেন বিক্ষোভকারীরা।
সাদ অনুসারীদের ইজতেমা মাঠে জোড় পালন করতে সরকার থেকেও অনুমতি নেই এমন দাবি করে ইজতেমা মাঠ না ছাড়ার ঘোষণা দেন তারা।
পরে ২০২৫ সালের বিশ্ব ইজতেমা সফল এবং ২০ ডিসেম্বর থেকে টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমায় মাওলানা সাদের উপস্থিতির দাবি জানায় তার অনুসারীরা। তারা রোববার সকালে টঙ্গী কামারপাড়া রোড এলাকায় সমাবেশ করে জোড় ইজতেমার অনুমতি এবং ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে আনতে সরকারের প্রতি সময় বেঁধে দেন। তারা পুলিশ কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
পরে বিকাল ৩টার দিকে টঙ্গী কামারপাড়া রোড এলাকায় তাবলিগের শুরায়ি নেজামের আহ্বানে উলামা মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতার ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখানে মূলত মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন।
সেই সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, “ইজতেমা নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখশ চৌধুরী ও জিএমপির কমিশনার নাজমুল করিম খান আওয়ামী লীগের দোসর। তাদের অপসারণ করতে হবে।”
সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে আমরা ইজতেমা ময়দানে আছি। যে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দায় ওই দুইজনকে নিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এর আগে ২০১৮ সালেও টঙ্গীতে জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।