ঢাকা | মে ১, ২০২৫ - ১১:০৭ পূর্বাহ্ন

ছাত্রলীগের নজিরবিহীন পঞ্চপাণ্ডবে তোলপাড় নিবন্ধন অধিদপ্তর

  • আপডেট: Wednesday, April 30, 2025 - 1:13 pm

মো. খায়রুল আলম খান।। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কারাগারে। আদালতে তার বিচার চলছে। কিন্তু ছাত্রলীগ কোটায় অবৈধভাবে তার নিয়োগ দেয়া সাবেক ছাত্রলীগের পাঁচ নেতা এখনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অধিকর্তা। নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) কার্যালয়ে পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে পরিচিত এই নেতারা পলাতক ছিলেন। ছয় মাস আত্মগোপনে থাকার পর কর্মস্থলে ফিরে এসে কোটি টাকার মধ্যস্থতায় পুনরায় স্বপদে বহালের চেষ্টা চলছে। তাদের অবৈধ নিয়োগ বাতিল ও গ্রেফতারের দাবিতে আইন বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ আইজিআর দফতরে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ রেজিস্টার এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

নির্বাচনী এলাকায় বাড়ি হওয়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কয়েকজনকে অফিস সহকারী পদে চাকরি দিয়েছিলেন নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) কার্যালয়ে। আইজিআর অফিসে চাকরির নিয়োগ পেলেও সব নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে নজিরবিহীনভাবে কিছু দিনের মধ্যেই তাদেরকে বদলি করা হয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। তাও আবার ঢাকার মতো বিভিন্ন অফিসে। তাদের নিয়োগ দেখানো হয় অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। আইনমন্ত্রীর নিজস্ব তদবিরে চাকরি হওয়ায় এরাই হয়ে ওঠেন রেজিস্ট্রি অফিসের একক নিয়ন্ত্রক। তাদের তোষামোদ করতেন খোদ জেলা রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। যেমনটি গোপালগঞ্জ জেলার কনস্টেবলও নিয়ন্ত্রণে রাখতেন থানার ওসিকে। রেজিস্ট্রি অফিসের নিয়ন্ত্রক এ রকম পাঁচজনের পরিচিতি হয় কসবার পঞ্চপা-ব হিসেবে। এরা হলেনÑ রাসেল, খন্দকার তুহিন, জয়নাল, ইমতিয়াজ আলম রিমন ও সামিউল। সহকারী হলেও এরা আইনমন্ত্রীর দোহাইয়ে যেকোনো ধরনের দলিল করিয়ে নেয়া, তদবির, বদলি, রেজিস্ট্রি অফিসের ভলিওম বইয়ের পাতা কাটাকাটির সাথে জড়িত থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। জুলাই বিপ্লবে পট-পরিবর্তনের পর এরা গা ঢাকা দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছেÑ সাবেক আইনমন্ত্রী কারাবন্দি থাকলেও তার দোসররা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যারা সরকার পরিবর্তনের পর অফিসে অনুপস্থিত থেকেও বেতন নিচ্ছেন নিয়মিত।

ফ্যাসিবাদ সরকারের শাসনামলেও অভিযুক্তদের অনিয়ম-খামখেয়ালিপনা, ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেছেন একাধিকবার। শুধু তা-ই নয়, দলিল করা থেকেও বিরত রাখা হয় একদিন। কিন্তু অভিযুক্তদের কিছুই হয়নি। উল্টো যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তারা বিভিন্নভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ওই কর্মচারীদের অবৈধ নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আইন বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ রেজিস্টার এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু এত দিনেও তাদের নিয়োগ আদেশ বাতিল না হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয় রেজিস্ট্রেশন বিধিমালা ৩০ (গ) ধারা অনুচ্ছেদ মোতাবেক অফিস সহকারী পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্থায়ী মোহরার ও টিসি মোহরারের জ্যেষ্ঠতাই একমাত্র মান নির্ণায়ক। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসমূহে সরাসরি কর্মচারী নিয়োগের বিধান না থাকায় পদোন্নতির মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণ করা হয়। কিন্তু উল্লিখিত ব্যক্তিদের সরাসরি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যা রেজিস্টেশন বিধিমালার পরিপন্থি। এতে করে নকলনবিশ ও কর্মচারীরা বৈষম্যের শিকার হয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন।

পঞ্চপান্ডবের একজন জয়নাল।
যিনি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এপিএস আলাউদ্দিন বাবুর নিকটাত্মীয়। বাবুর বাড়ি কসবায়। আনিসুল হকের গ্রামের প্রতিবেশী। সবগুলো নিয়োগেরই ব্যবস্থা করেন এপিএস বাবু। ছাত্রলীগ কোটায় ২০১৬ সালে আইজিআর অফিসে নিয়োগ পান জয়নাল। কিন্তু ২০১৯ সালে তাকে আইনমন্ত্রীর নির্দেশে ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে কম্পিউটার পদে বদলি করেন আইজিআর। একজন অফিস সহকারীকে কম্পিউটার অপারেটর পদে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুযোগ নেই। তেজগাঁও রেজিস্টেশন কমপ্লেক্সে ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যোগদানের পরেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জয়নাল। বড় বড় দলিলের পাতা ছেড়া, জাল-জালিয়াতি করা, ঘুষের মাধ্যমে ভুয়া নামজারি ও দলিল করত। দলিল লেখকরা ঘুষ দিতে না চাইলে তাদের মারধরসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করত। সাব-রেজিস্ট্রার এমনকি বিচারক পর্যন্ত বদলির তদবিরের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ভুয়া দলিল (নং-১১৫০) সৃজন করার পেছনে জয়নালের ভূমিকা ছিল। তার আরো কিছু জাল দলিলের বিষয়ে দুদক তদন্ত শুরু করে। কিন্তু উপরের নির্দেশে সব চিঠি চাপা পড়ে যায়। এক দলিলে ১৩ লাখ টাকা নিয়ে পাতা পাল্টানোর মামলা হলে জয়নালকে চাকরিচ্যুত কিংবা বিভাগীয় শাস্তি না দিয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদ থেকে কেরানীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে অফিস সহকারী পদে বদলি করেন তৎকালীন জেলা রেজিস্ট্রার।

ইমতিয়াজ আলম।
ইমতিয়াজ আলম কসবার সেলিম চেয়ারম্যানের ছেলে। একইভাবে আইজিআর অফিসে নিয়োগ পেয়েছিলেন বর্তমানে শ্যামপুর রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত ইমতিয়াজ আলম। ভুয়া কাগজে চাকরি নেয় ২০১৬ সালে। কম্পিউটার অপারেটর পদে থেকেও অফিসে কসবা সিন্ডিকেড করে। প্রভাব খাটিয়ে টানা প্রায় ১০ বছর তিনি একই অফিসে কাজ করেন। দলিল প্রতি লাখ টাকার চুক্তি না করে দাতা-গ্রহীতাকে সাব রেজিস্ট্রারের কাছে যেতে দিতেন না। এ ব্যাপারে এক ব্যাংক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করলেও কসবার বাসিন্দা হওয়ায় তদন্ত করেনি পুলিশ। সাব-রেজিস্ট্রারদের জিম্মি করে রাখত সে। এ জন্য কর্মচারীরা আন্দোলনও করেছিল। তবুও তাকে শাস্তি না দিয়ে তেজগাঁও কমপ্লেক্সের পল্লবীতে বদলি করে। এক মাসের মাথায় তাকে পুনরায় শ্যামপুরে নেয়া হয়। ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে কসবা থানায় মামলা হয়। এখনো তিনি অফিসে অনুপস্থিত থাকলেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

রাসেল মিয়া।
আইজিআর অফিস থেকে তাকে অবৈধভাবে সরাসরি বদলি করা হয় সাভার সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে ২০১৬ সালে। তার এ বদলি নিয়ে তখন সারা দেশের কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেন। একদিন বন্ধ রাখা হয় দলিল রেজিস্ট্র্রি। কিন্তু উল্টো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তখন হয়রানি করেন আন্দোলন করা কর্মচারীদের। আইনমন্ত্রীর পাশের বাড়ির লোক রাসেল। সাভারে এক বছর চাকরি না করতেই তাকে তেজগাঁও রেজিস্ট্র্রি কমপ্লেক্সের বাড্ডা সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিসে বদলি করা হয়। সেই থেকে বাড্ডা অফিসেই ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক। তার নামেও কসবা থানায় মামলা রয়েছে। মাঝে অফিসে এলেও তাকে বসতে দেয়নি কেউ। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার তাকে গত ১৩ মার্চ বদলির আদেশ দেন। কোটি কোটি টাকার মালিক রাসেল কসবায় গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য।

খন্দকার তুহিন।
খন্দকার তুহিন সাবেক আইনমন্ত্রীর পিএস মাসুমের আপন ভাতিজা। ২০১৫ সালে আইজিআর অফিসে নিয়োগ নিয়ে এক বছরের মধ্যেই ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বদলি হন। তার এ অবৈধ বদলির প্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রি বিভাগের কর্মচারীরা কাফনের কাপড় বেঁধে আন্দোলন করে। দুদিন ধরে চলে কলম-বিরতি। কিছুদিন পরে ডেমরা থেকে তেজগাঁওয়ের বাড্ডা রেজিস্ট্রি অফিসে বদলি হন তুহিন। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে তখন অসন্তোষ বিরাজ করে। এরপর দীর্ঘদিন ধরে উত্তরা অফিস হয়ে সর্বশেষ সাভার অফিসে বদলি হন। ৫ আগস্টের পর অফিস না করলেও কর্তৃপক্ষ নীরব।

সামিউল।
কসবার বাসিন্দা সামিউল ২০১৬ সালে আইজিআর অফিসে অবৈধ নিয়োগের পর এক বছরের মধ্যে বদলি হন পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। এই সামিউলের আপন ভাই আলাউদ্দিন বাবু। যিনি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গুলশানের বাসার দেখাশোনা করেন। সামিউলেরও চাকরি হয় ছাত্রলীগ কোটায়। চাকরি নেয়ার সময় বয়স কমানোর কারণে বেতন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। গত ৫ আগস্ট থেকে অফিসে অনুপস্থিত ছিল। সম্প্রতি সে অফিসে আনাগোনা শুরু করেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার মোখলেছুর রহমান জাগোজনতাকে বলেন, অভিযুক্ত সহকারীদের প্রমোশন ও বদলি নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। তারা আইজিআর অফিসের সরাসরি নিয়োগপত্রে জয়েন্ট করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি নির্দেশ দেয় তা অধীনস্তরা মানতে বাধ্য। যেখান থেকে তাদের নিয়োগপত্র হয়েছে এটি তাদের বিবেচ্য বিষয়। অভিযুক্তদের অফিসে অনুপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে মোখলেছুর রহমান আর বলেন, তেজগাঁও রেজিস্টেশন কমপ্লেক্সের কর্মচারী সামিউল ও রাসেল গত ৫ আগস্টের পরে একাধিকবার ছুটি নেয়। পরে অসুস্থতার দোহাইয়ে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে আবারো ছুটি নেয়। পরে যোগদান করে আবারো অনুপস্থিত থাকলে তাদের দু’জনকে শোকজ করা হয়। শোকজের প্রেক্ষিতে তারা কর্মস্থলে যোগদান করে। পরে তাদের বদলি করা হয়। বাকিদের অনুপস্থিতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারগণ তাকে কিছুই অবহিত করেনি। বিষয়টি যেহেতু নজরে এসেছে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।