কিশোর গ্যাংয়ের দখলে মিরপুরের অপরাধ সাম্রাজ্য
মো: খায়রুল আলম খান : পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামল থেকেই মিরপুরের সাত থানার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চাঁদাবাজি, দখল, মাদক কারবার, ছিনতাই ও টার্গেট কিলিংয়ে। সাম্প্রতিক ছাত্র-গণআন্দোলনে বিগত সরকারের পতনের পর পুলিশি নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়ায় এই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ, বিকাশ, শাহাদত, ইব্রাহিম ও কিলার আব্বাসদের এই অপরাধ সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে নিতে বর্তমানে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ কারণে তারা বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, পর্দার আড়াল থেকে এসব গ্রুপকে আশ্রয় দিচ্ছে সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কয়েকজন। মাঠপর্যায়ের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে আবার বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতেও রয়েছে। এই সন্ত্রাসীদের শুধু বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগের পলাতক কয়েক নেতাও ইন্ধন জোগাচ্ছে।
এলাকাবাসী বলছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গত তিন মাসে মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেক. পল্লবী, দারুস সালাম, রূপনগর, শাহআলী থানা এলাকায় ব্যাপকভাবে নীরব চাঁদাবাজি চলছে। সন্ধ্যার পর ছিনতাই চুরি ডাকাতি হয়েছে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে। এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাদক কারবারিরাও ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকার বিভিন্ন মার্কেট, ফুটপাত দখল নিয়ে সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি, সংঘাত ও হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অধিকাংশ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি কিংবা মামলা নেয়নি পুলিশ। এতে মিরপুরের সাধারণ মানুষজন অনেকটা আতঙ্কে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতা মোহাম্মদ সেলিম জাগোজনতাকে বলেন, ‘বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ মানুষ ভীত ছিল। তারা এখন পলাতক। তবে তাদেরই ছত্রছায়ায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি, দখল, মাদক কারবার, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারের পতনের পর বিগত ব্ছরগুলোয় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীরা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় যাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বেড়ে গেছে। দখল ও আধিপত্য নিয়েও সন্ত্রাসীদের মধ্যে অনেক সময় মারামারি হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নেতাদের। কোনো নেতাকর্মী চাঁদাবাজি বা কিশোর গ্যাংকে সেল্টার দিলে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
পুলিশ যা বলছে
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাকছেদুর রহমান বলেন, ‘মিরপুরের ৭ থানাকেন্দ্রিক অপরাধীদের তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে। এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোতে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হলে পুলিশ অভিযান পরিচালনা ও গ্রেপ্তার করছে। চাঁদাবাজি ও দখল নিয়ে পুলিশের কাছে এখনও কোনো অভিযোগ আসেনি। এ ধরনের অভিযোগ পেলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। অভিযোগ নিলেও সেটি তদন্ত করে মামলা হতে পারে।’
বৃহত্তর মিরপুরের পল্লবী এলাকার বিভিন্ন ঘটনা এবং সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা সম্পর্কে পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম জাগোজনতাকে বলেন, সাম্প্রতিক বেশিরভাগ ঘটনাতেই মামলা হয়েছে এবং আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যেমন কিশোর গ্যাং আশিক গ্রুপের আশিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট পল্লবী থানা লুট হয়। সাথে অস্ত্রও লুট হয়েছে। এ সময় কিশোর গ্যাং সদস্য, ছিনতাইকারী, মাদক ও অস্ত্র কারবারিসহ অপরাধীদের যে ডেটা পদ্ধতি গড়ে তোলা হচ্ছিল, তা-ও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেক অপরাধীর তথ্য আর পুলিশের কাছেও নেই। পুলিশ চেষ্টা করছে তালিকা হালনাগাদ করে তাদের চিহ্নিত করতে। তিনি স্বীকার করেন, একসময় সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লার ডানহাত কসাই খলিল কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করত। এখন তারা পলাতক থাকায় সংশ্লিষ্ট গ্যাংগুলো বিচ্ছিন্ন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
সক্রিয় যেসব কিশোর গ্যাং
পুলিশের এক প্রতিবেদনে বৃহত্তর মিরপুরের সাতটি থানা এলাকায় (মিরপুর, পল্লবী, দারুস সালাম, রূপনগর, শাহআলী, ভাষানটেক, কাফরুল) সক্রিয় কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের নাম উঠে এসেছে। এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে সুমন ব্যাপারী গ্যাং, পিচ্চি বাবু গ্যাং, বিহারী রাশেল গ্রুপ, বিচ্ছু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন ও রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং, এবল মোবারক গ্যাং, অপু গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, নাডা ইসমাইল গ্রুপ, হ্যাপি গ্রুপ, সজীব গ্রুপ, বগা হৃদয় গ্রুপ, ভাস্কর গ্রুপ, রবিন গ্রুপ, এলকে ডেভিল বা বয়েজ এলকে তালতলা গ্রুপ, পটেটো রুবেল গ্রুপ, অতুল গ্রুপ, আশিক গ্রুপ, জল্লা মিলন গ্রুপ, রকি গ্রুপ, পিন্টু-কাল্লু গ্রুপ, মুসা হারুন গ্রুপ ওরফে ভাই ভাই গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, সোহেল গ্রুপ, ইয়াসিন গ্রুপ, ইমন ও জুয়েল গ্রুপ, রকি গ্যাং, রাজিব গ্যাং, ভইরা দে গাং, ধইরা দে গ্যাং, রিংকু গ্রুপ, হীরা গ্রুপ, ভোলা গ্রুপ, অপু গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, শাহ কিবরিয়া গ্রুপ, শাহিন গ্রুপ, গোলাম রাব্বানী গ্রুপ এবং এলাচ জুয়েল গ্যাং।
এলাকাবাসী বলছে, শুধু পল্লবী ও কাফরুল থানা এলাকায় ৩৫টির মতো এবং মিরপুরে ১০টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। সব মিলিয়ে সাত থানা এলাকায় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে।
নেপথ্যে কারা
জাগোজনতার অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি, তার ছোট ভাই (পলাতক) ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রউফ নান্নু এবং আরও দুই সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী ও দেওয়ান আব্দুল মান্নানের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে এই কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে উঠেছে। সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ডানহাত হিসেবে পরিচিত কসাই খলিলও একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ তৈরি করেছে। এসব গ্যাং দিয়ে পল্লবী এলাকায় জমি ও বাড়ি দখল করা ছিল কসাই খলিলের মূল কাজ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কসাই খলিল আত্মগোপনে চলে গেলেও তার গ্রুপগুলো এখনও সক্রিয়। আগে বৃহত্তর মিরপুরের সব কিশোর গ্যাং ও তাদের বড় ভাইয়েরা এসএম মান্নান কচির নিয়ন্ত্রণেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পীর ছোট ভাই যুবলীগ নেতা সজলের নিয়ন্ত্রণে এখনও সক্রিয় একাধিক কিশোর গ্যাং। সজলের সঙ্গে গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত সাবেক এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার কথিত ছেলে বিহারী রকি। বিহারী রকির ভাই জনি ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ হেফাজতে মারা যায়। বিহারী রকি ও সজল এখনও পল্লবী এলাকার ত্রাস। পল্লবীতে ‘ভইরা দে’ গ্রুপের প্রধান হচ্ছে মিরপুরের শীর্ষ মাদক কারবারি ফাতেহের ভাই অনিক। মিরপুর ১২ এলাকায় পল্লবী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুমন ব্যাপারীর কিশোর গ্যাংগুলো এখনও সক্রিয়। সুমন ব্যাপারী মিরপুরে শাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার আসামি। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে এসে সে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
কোন এলাকা কার নিয়ন্ত্রণে
এই গ্যাং বা গ্রুপগুলো কখনও কখনও নিজেরা বসে তাদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নেয়। আবার আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে সংঘর্ষও বাধে। বৃহত্তর মিরপুরের সাত থানা এলাকার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জোন আবার ‘ভয়ংকর এলাকা’ হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণকারীরাও আর দশজনের চেয়ে বেশি ভয়ংকর।
এদের মধ্যে মুক্তার ওরফে হাড্ডি মোক্তার, শাহিন শিকদার, কিলার শাহাদত (তিনজনই বর্তমানে ভারতে পলাতক), গ্যাং বাবু, রাজন, দিপু, ফিতা হাসান, ইমন, তারবো বাবু ও চোরা সেলিম নিয়ন্ত্রণ করে পল্লবী এলাকা। মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করে পিচ্চি মুরাদ, কালা বাবু, আব্বাস, রনি বৃন্দাবন, প্রকাশ ঘরামি, সুপক মন্ডল, সোহেল, আমিন, মেহেদি, ভাগিনা মাসুম, ইব্রাহিম, মামুন ওরফে পাগলা মামুন, মঞ্জু ওরফে শাখারী মঞ্জু, কাইল্লা মোতাবেল; পুলিশের সোর্স দুলাল, জয়নাল ও হিটলু বাবু। এদের সবার নেপথ্যে রয়েছে পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রসী কিলার শাহাদত ও শাহিন শিকদার। শাহাদত এখন ভারতে পালিয়ে আছে এবং সেখান থেকেই ঢাকার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছে। মিরপুরে এদের প্রতিপক্ষ বিএনপি সমর্থিত আরেকটি গ্রুপ রয়েছে, যারা তিন ভাই গ্রুপ নামে পরিচিত। এই তিন ভাই হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন, মশিউর ও জামিল। ভাষানটেক থানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম গ্রুপের যুবরাজ ও শুটার ওরফে কিলার বাবু। শাহআলী ও দারুস সালাম এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা ইসলাম ও যুবলীগ নেতা নাবিল।
কলকাঠি নাড়ছেন যেসব ‘বড় ভাই’
কিশোর গ্যাংয়ের এই নিয়ন্ত্রণকারীদেরও রয়েছেন বেশ কয়েকজন বড় ভাই। তাদের অধিকাংশই পলাতক। কেউ দেশে কেউবা দেশের বাইরে। এসব সন্ত্রাসী বড় ভাইদের মধ্যে আছেন সাজু, ডিপজল, কফিল, কামাল মজুমদার, নিখিল, মান্নান কচি, হানিফ, ইলিয়াস মোল্লা, কামরুল, ইব্রাহিম, কিলার আব্বাস, কিলার শাহাদাত, বালতি মিজান ও বাবু।
সাতটি থানায় অপরাধের কিছু ঘটনা
পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে একটি। দস্যুতা (ছিনতাই) হয়েছে ১৮টি, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৫৪টি। এ ছাড়া সাতটি অপহরণ এবং ৭৭টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে ঘটনা ঘটেছে আরও বেশি। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলেও কেউ সাহস দেখায়নি থানায় গিয়ে অভিযোগ করার।
গত ৪ নভেম্বর রাত ১০টায় পল্লবীর ১১ নম্বরের অ্যাভিনিউ ৪-এর সবুজবাংলা গেটে একটি সেলুনে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে কিশোর গ্যাং উজ্জ্বল গ্রুপ। এ গ্রুপের সদস্য রকিসহ কয়েকজন সেলুনটিতে হামলা চালানোর সময় সেখানে রাজিব নামের এক প্রবাসী অবস্থান করছিলেন। উজ্জ্বল গ্রুপের সদস্যরা ওই প্রবাসীর কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তার ওপর হামলা চালায়। এরপর সেলুন ভাঙচুর করে তারা ১ লাখ টাকা লুটে নিয়ে যায়। সেলুন মালিক শাকিল জানিয়েছেন, এই ঘটনায় তিনি পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি। তিনি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে চলে আসেন। থানা থেকে তাকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সেলুন মালিক আরও জানান, স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল এলাস জুয়েল গ্রুপ। এদের একটি উপদল ‘উজ্জ্বল গ্রুপ’ নামে পরিচিত। সকাল ১০টার দিকে এই উজ্জ্বল গ্রুপের কমপক্ষে অর্ধশত সদস্য অস্ত্র নিয়ে দোকানে এসে প্রথমে রাজিবকে কুপিয়ে জখম ও পরে সেলুন ভাঙচুর করে ১ লাখ টাকা নিয়ে যায়।
শাকিলের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত স্থানীয় আরেক ব্যবসায়ী জানান, এই গ্রুপ গত ৫ আগস্টের পর স্থানীয় সবুজবাংলা মার্কেট এলাকা থেকে শুরু করে পল্লবীর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে। কেউ চাঁদা না দিলে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। তাদের নামে থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ তা নিতে অস্বীকার করে। উল্টো কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদেরই ভুক্তভোগীদের নামে মামলা করতে দেখা গেছে। আর রহস্যজনক কারণে থানা এদের মামলা ঠিকই গ্রহণ করেছে।
গত ৩০ অক্টোবর দুটি সন্ত্রাসী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে পল্লবীর বাউনিয়ারটেক এলাকায় আয়শা নামের এক নারী নিহত হন। এই ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং সদস্যদের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে।
গত ২৭ অক্টোবর দুপুরে পল্লবী থানার মিরপুর ডিওএইচএসের এক বাসায় ঢুকে বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার আব্দুল মতিনের স্ত্রী ফারাহ দিবাকে হত্যা করে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল। তার বাসা থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকারও লুট করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সোমবার গভীর রাতে মিরপুরে স্টেডিয়াম রোড এলাকায় প্রাইভেটকার চালক ওমর ফারুককে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
গত ২৭ আগস্ট মিরপুর দারুস সালাম সড়কে মিরপুর টাওয়ারের সামনে রিকশার গতি রোধ করে সফটওয়্যার প্রকৌশলী জাররাফ আহমেদ প্রিতমকে হত্যা করে একটি ম্যাকবুক ও মোবাইল ফোনসহ নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে কিশোর গ্যাং। এ ঘটনায় নিহতের চাচাতো বোন কানিজ শারমিন দারুস সালাম থানায় মামলা করেছেন।
গত ৭ অক্টোবর রাত থেকে ৮ অক্টোবর রাতের মধ্যে মিরপুর মডেল থানার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় এফএস স্কয়ার শপিংমহলের তৃতীয় তলার দুটি স্বর্ণের দোকান থেকে সংঘবদ্ধ চোরের দল ৩ কোটি ৯ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার ও ডায়মন্ডের গহনা চুরি করে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী তোফায়েল হোসেন এবং সালাউদ্দিন খানের দোকানে ওই চুরির ঘটনা ঘটে। কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা এ চুরির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১০ অক্টোবর ধানমন্ডির বাসিন্দা হারুন অর রশিদ নামের এক ব্যক্তি ফ্ল্যাট কিনতে বুকিং দেওয়ার জন্য মিরপুরের ৯ নম্বর সেকশনে গেলে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ অস্ত্রের মুখে তার কাছ থেকে ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার ও টাকা উদ্ধার করে।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর শাহআলী এলাকার মহিলা কলেজের সামনে খাবার বিক্রেতা সালমা বেগম ও তার ছেলে জীবনের কাছে চাঁদা দাবি করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সজীব। তাদের দাবি ছিল, তাদেরকে প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। কিন্তু তা না পেয়ে কুপিয়ে গ্যাংয়ের সদস্যরা জখম করে সালমা ও জীবনকে। একই সময় তারা দোকান থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী জীবন শাহআলী থানায় মামলা করেন। তখন দারুস সালাম থানা এলাকায় জীবনের ওপর আবারও হামলা চালায় সজীব গ্রুপ। এ ঘটনায় দারুস সালাম থানায় আরেকটি মামলা হয়। ঘটনার দেড় মাস পরও কিশোর গ্যাং সজীব গ্রুপের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
এ বিষয়ে শাহআলী থানার ওসি জানান মাহমুদুল হাসান দাবি করেন, চাঁদার জন্য নয়, আধিপত্য নিয়ে দুই গ্রুপের মারামারি হয়েছে। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সদস্য জীবন ও তার মাকে কুপিয়েছে। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় দুইপক্ষের লোক গ্রেপ্তার হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলার একটি অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুট করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বৃহত্তর মিরপুর এলাকায়।