কাপাসিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের কথা বললে প্রথমেই আসে শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর নাম। এ দুই নদীর তীরবর্তী মনোরম পরিবেশ গ্রামীণ পর্যটনের জন্য একটি বিশাল সম্পদ। নদীর ধারে নৌভ্রমণ, কটেজ, রিসোর্ট এবং ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা করা গেলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব। নদীর তীরে পুরনো ঘাট, দিঘি ও মেলার মতো ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে নতুনভাবে সাজানো হলে কাপাসিয়া দ্রুতই একটি জনপ্রিয় নদীতীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।
ঐতিহাসিক নিদর্শনের দিক থেকেও কাপাসিয়া সমৃদ্ধ। সুলতানপুর শাহি মসজিদ, দলোহাদীর লোহার খনি, ধাঁধারচর, গজারি ঘরসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো পর্যটনের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় হতে পারে। এসব স্থাপনা বর্তমানে অবহেলায় ও অবৈধ দখলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে এসব দখলমুক্ত করে সংস্কার করা হলে এবং স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করা গেলে এগুলোকে দেশের ঐতিহাসিক পর্যটন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এতে যেমন ঐতিহ্য রক্ষা হবে, তেমনি স্থানীয়দের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের পথ তৈরি হবে।
কাপাসিয়া শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবেও একসময় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। কার্পাসের চাষ ও মসলিন উৎপাদনের জন্য এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। নৌপথে সুদূর আরব পর্যন্ত কাপাসিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আবার ১৬১০ সালে বাংলার সুবেদার ইসলাম খান রাজধানী স্থানান্তরের জন্য প্রথমে কাপাসিয়ায় এলেও ভূখণ্ড উঁচু-নিচু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেছে নেন। ইতিহাসের এসব অধ্যায় পর্যটন উন্নয়নের জন্য এক অনন্য উপাদান। পর্যটকদের কাছে এসব কাহিনি তুলে ধরলে কাপাসিয়ার গুরুত্ব বাড়বে বহুগুণে।
পর্যটন শিল্প গড়ে উঠলে এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে কাপাসিয়ার অর্থনীতিতে। স্থানীয় যুবকরা ট্যুর গাইড, হোটেল-রিসোর্টের কর্মী, রেস্টুরেন্ট মালিক কিংবা ট্রাভেল এজেন্সির উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে পারবে। গ্রামীণ নারীরাও হস্তশিল্প, দেশীয় খাবার, কুটির শিল্প ও কৃষিপণ্যের মাধ্যমে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন। এভাবে পর্যটন শুধু চাকরি নয়, বরং উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখবে।
তবে এ সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু করণীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. অবকাঠামো উন্নয়ন: সড়ক, সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া পর্যটক আকর্ষণ সম্ভব নয়। কাপাসিয়ার কাঁচা রাস্তাগুলো দ্রুত পাকা করা জরুরি।
২. ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ: সুলতানপুর মসজিদ, গজারি ঘর, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংস্কার ও সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে।
৩. নদীতীর উন্নয়ন: শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে নৌভ্রমণ, ইকো-ট্যুরিজম, রিসোর্ট ও সাংস্কৃতিক মেলার আয়োজন করতে হবে।
৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন: স্থানীয় তরুণদের পর্যটন ব্যবস্থাপনা, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও গাইডিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৫. সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ: সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ আনতে হবে। পর্যটন শিল্পে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেল কার্যকর হতে পারে।
৬. সচেতনতা ও অংশগ্রহণ: স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে যাতে তারা পর্যটন কেন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
কাপাসিয়ার রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বিত সম্পদ। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা গেলে এখানকার বেকারত্ব দূর হবে, অর্থনীতি চাঙা হবে, একইসঙ্গে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণও সম্ভব হবে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সরকারি উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের সচেতনতা। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে কাপাসিয়া শুধু একটি উপজেলা নয়, বরং দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।
লেখক : প্রভাষক – ব্রেভ জুবিলেন্ট স্কলার্স অফ মনোহরদী মডেল কলেজ (বি জে এস এম মডেল কলেজ) মনোহরদী, নরসিংদী। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা – ওয়েলফশন মানবকল্যাণ সংঘ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।