অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এর সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে নানা আধুনিক ট্রেড এবং প্রযুক্তিনির্ভর কোর্স চালু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখছে আইওটি (IoT), রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি এবং অটোমেশনের মতো বিষয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং ইন্ডাস্ট্রি ইন্টার্নশিপের সুযোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তরুণদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহও ক্রমেই বাড়ছে। ২০০৯ সালে যেখানে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হার ছিল এক শতাংশের নিচে, বর্তমানে তা প্রায় ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এই প্রবৃদ্ধি ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর কর্মবাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
বৈশ্বিক উদাহরণ
জার্মানির ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম শিল্প এবং শিক্ষাকে একসূত্রে বেঁধে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন পথ তৈরি করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পে স্মার্ট ফ্যাক্টরি স্থাপনের মাধ্যমে উৎপাদন দক্ষতা সাত শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঙ্গাপুরে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাব-টু-ইন্ডাস্ট্রি প্রোগ্রাম চালু আছে, যাতে তারা সরাসরি প্রযুক্তি-নির্ভর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশেও একই ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি অংশীদারিত্বে ইনোভেশন ল্যাব, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার এবং গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা তৈরির নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে।
কারিগরি শিক্ষার নবযাত্রা
ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ যুগে কারিগরি শিক্ষা শুধু পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়, এটি সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্র। শিক্ষার্থীরা শিখছে বাস্তব সমস্যার সমাধান, নতুন ধারণা বিকাশ এবং প্রযুক্তি-নির্ভর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে। দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিকে এখন ভার্চুয়াল ল্যাব, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং অনলাইন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করছে, যা ভবিষ্যতের কর্মবাজারে তাদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে।
তরুণদের শক্তি এবং সম্ভাবনা
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ তরুণ। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দশকে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের তরুণরা যদি প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তবে তারা শুধু দেশের নয়, বৈশ্বিক বাজারেও অবদান রাখতে পারবে। বর্তমানে অনেক তরুণ নতুন উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছে—স্টার্টআপ, ই-কমার্স, ডিজিটাল সার্ভিস, পর্যটন, কৃষি এবং স্বাস্থ্যসেবায় তারা নতুন ধারণা বাস্তবায়ন করছে। প্রযুক্তি-নির্ভর এই তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার সবচেয়ে বড় আশার প্রতীক।
সম্ভাবনার বাংলাদেশ
ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। উৎপাদন থেকে পর্যটন, কৃষি থেকে তথ্যপ্রযুক্তি সব ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।কারিগরি শিক্ষা হবে এই পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি। আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ এবং উদ্ভাবনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়েই বাংলাদেশ টেকসই অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ এখন এক সম্ভাবনাময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ যুগে দেশের তরুণ এবং দক্ষ জনগোষ্ঠীই হবে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ভিত্তি। প্রযুক্তি, জ্ঞান এবং উদ্ভাবনের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে এক কর্মক্ষম, উৎপাদনশীল এবং আধুনিক বাংলাদেশ, যার পথে আমরা ইতিমধ্যেই এগিয়ে চলেছি।
লেখক: ইনস্ট্রাক্টর (টেক) ও বিভাগীয় প্রধান
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।