ঢাকা | অক্টোবর ১৫, ২০২৫ - ৮:৪৫ অপরাহ্ন

শিরোনাম

লামায় অবৈধ বালু উত্তোলনে কঠোর অভিযান, রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড

  • আপডেট: Wednesday, October 15, 2025 - 5:49 pm

নিজস্ব প্রতিবেদক।
বান্দরবানের লামা উপজেলায় পরিবেশ রক্ষা ও সরকারি রাজস্ব আদায়ে উপজেলা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একদিকে যেমন অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তেমনি নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায়ে অর্জিত হয়েছে রেকর্ড সাফল্য।

সর্বশেষ বুধবার (১৫ অক্টোবর ২০২৫) দুপুরে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের আমতলী সরই খালে অভিযান পরিচালনা করে আনুমানিক ২ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট অবৈধভাবে উত্তোলিত বালি জব্দ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মইন উদ্দিন এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবায়েত আহমেদ। এর আগে একই দিন সরই ইউনিয়নের তিনটি নির্ধারিত পয়েন্টে বৈধ বালু নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন করেন উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু নিলাম শেষে প্রশাসনের নজরে আসে, আমতলী এলাকায় কিছু অসাধু ব্যক্তি শেলু মেশিন ব্যবহার করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। খবর পেয়ে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং বিপুল পরিমাণ বালি জব্দ করা হলেও অভিযুক্তদের কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।

অভিযানের বিষয়ে ইউএনও মো. মইন উদ্দিন বলেন, “নদী ও খালের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রশাসন সবসময় জনগণের স্বার্থে এবং পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় থাকবে। লামায় কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি ইউনিয়নে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। যেসব এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন বা পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে, সেসব স্থানে নিয়মিত অভিযান চলবে।”

লামা উপজেলা প্রশাসনের অধীনে নিয়মিতভাবে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট অভিযানে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায়ে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ইউএনও ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মইন উদ্দিন ২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানে সরকারের রাজস্ব খাতে আদায় হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৪২ হাজার ৫০ টাকা। একই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন আইন লঙ্ঘনের দায়ে ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

এই সময়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী আদায় হয়েছে ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুসারে আদায় হয়েছে ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বালুমহল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুসারে আদায় হয়েছে ৯ লাখ টাকা জরিমানা এবং একই আইনে ৭ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ৫৭ হাজার টাকা, ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ১৯ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬ অনুযায়ী ১৩ হাজার টাকা, পেট্রোলিয়াম আইন, ২০১৬ অনুযায়ী ১৩ হাজার টাকা, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ১০ হাজার টাকা, বন আইন অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী ৪০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বালু নিলাম কার্যক্রম থেকে একাই সরকার পেয়েছে ৬৭ লাখ ৮ হাজার ৭৫০ টাকা রাজস্ব, যা এই সময়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে এক অভূতপূর্ব সাফল্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। লামা উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত আট মাসে ৪৫টিরও বেশি মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল পরিবেশ সংরক্ষণ, ভেজালবিরোধী কার্যক্রম, অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ, ওজন কারচুপি প্রতিরোধ এবং বালুমহল রক্ষা বিষয়ক।

লামার বিভিন্ন এলাকায় একসময় নির্বিচারে নদী খনন, পাহাড় কাটাসহ বালু উত্তোলনের কারণে প্রকৃতি বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ইউএনও মইন উদ্দিন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে নেমে এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। তিনি নিয়মিতভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পরিবেশবাদী সংগঠন, সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন, নিয়মিত অভিযানের ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ওজনে প্রতারণা কমেছে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য অনেকটাই ফিরে এসেছে। বিশেষ করে নদী ও খালে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য সম্পদ রক্ষিত হচ্ছে। সরই ইউনিয়নের এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে নদীর পাড় কেটে বালু তোলা হতো, খাল শুকিয়ে যেত। এখন ইউএনও স্যারের উদ্যোগে এসব বন্ধ হয়েছে। বাজারেও নিয়মিত তদারকি হয় ওজনে ঠকতে হয় না।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মইন উদ্দিন বলেন, আইনের শাসন নিশ্চিত করা, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং স্বচ্ছ রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের আয় বৃদ্ধি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে লামা উপজেলাকে আমরা একটি সুশাসন ও পরিবেশবান্ধব মডেল উপজেলায় রূপ দিতে পারব।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাঠ প্রশাসনের এমন কার্যকর ভূমিকা কেবল লামা নয়, পুরো বান্দরবান জেলার জন্যই একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠছে। প্রশাসনের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে লামা উপজেলা ভবিষ্যতে সুশাসন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও অনুপ্রেরণার মডেল হবে।