অনিয়মের আর দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
নিজস্ব প্রতিবেদক: বান্দরবান জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দিন দিন স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীন ন্যাস্ত হওয়ার দরূন তাদের ইচ্ছে মতো আত্মীয় স্বজন ও কাছের লোকদের টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দিচ্ছে। এগুলোর জবাব চাইতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এর অজুহাত দেখিয়ে দেন।
বান্দরবানের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর বিধিমালা অনুযায়ী আবেদন করে তথ্য পাচ্ছেন না বলে এ অভিযোগ করেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। চলতি বছরের ৬ জুন বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে সরকারি বিধি মোতাবেক নির্ধারিত ফরমে তথ্য চেয়ে আবেদন করেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি। জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ এই তিন অর্থবছরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য চাওয়া হয় এতে। কিন্তু অদ্যাবধি আইন অনুযায়ী তথ্য দিচ্ছেন না জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল। এছাড়াও দৈনিক যায় যায় দিনের বান্দরবান প্রতিনিধি ক্যমুই অং মারমা, ভোরের কাগজের মংসানু মারমা, জি.টিভির প্রতিনিধি মোঃ ইসহাক, শৈহ্লাচিং মারমা সহ আরো অনেকে তথ্য চেয়ে পাননি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘যদি তথ্য চাওয়ার পরও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর তা না দেয়, তাহলে মনে করবেন কাজে কোনও অনিয়ম হয়েছে। তাদের অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী তথ্য দিতে বাধ্য করবেন।’
এদিকে বান্দরবান পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের উজানীপাড়া এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুরে ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি মিনি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এমটিপি) নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নির্মাণের পর এগুলো কোনো কাজে আসেনি। এখন মশা প্রজননকেন্দ্রে
উজানীপাড়ার ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি রাংলাই ম্রো বলেন, এমটিপি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে মশা। মশার উৎপাতে এলাকাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ। অবিলম্বে ট্রিটমেন্ট চালু বা ভেঙে ফেলার দাবি জানান তিনি। পরিত্যক্ত পানি শোধনাগার বান্দরবানের আরেক পৌরসভা লামায় সুপেয় পানির সমস্যা নিরসনে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে মাঝপথে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। জলাধার ও পানি শোধনাগার নির্মিণ সংকটে রয়েছে। এতো টাকা খরচ হলেও পানি সরবরাহের মূল কাজই হয়নি। এখন তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
বান্দরবান পৌরবাসীর পানির সংকট নিরসনে দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নেয়া মিনি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান’ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পানির রিজার্ভার করা হলেও ট্রিটমেন্ট প্ল্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন, সাবমারসিবল পাম্প মোটর বসানো ও বৈদ্যুতিক সংযোগ তার লাগানোসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো করা হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ- পুরনো প্রকল্প সংস্কার করে নতুন দেখিয়ে অফিসের যোগসাজশে প্রকল্পের বিলের পুরো টাকাই উত্তোলন করে নিয়েছেন ঠিকাদার। পৌরবাসীর পানির সংকটে নেয়া ‘মিনি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান’ প্রকল্পটি জনগণের কোনো কাজেই আসছে না।
জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বান্দরবান পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে পৌরবাসীর পানি সংকট নিরসনে দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘মিনি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান’ প্রকল্পের টেন্ডার দেয়া হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রতন সেন তঞ্চঙ্গ্যাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায়। প্রকল্পের কাজগুলো হচ্ছে- সাঙ্গু নদীর পাড়ে পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের ইসলামপুরে একটি, ৬নং ওয়ার্ডের নতুন পাড়ায় একটি ও ৫নং ওয়ার্ডের উজানীপাড়ায় একটি আরসিসি রিজার্ভার নির্মাণ। প্রতিটি রিজার্ভার তৈরিতে। ব্যয় হয়েছে ৩১ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাঙ্গু নদী থেকে প্রতিটি রিজার্ভ ট্যাংকে পানি উত্তোলন ও রিজার্ভার থেকে আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সাবমারসিবল পাম্প মোটর ক্রয়, ৫ লাখ টাকার ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ক্রয় ও রিজার্ভার থেকে আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন এবং উপকারভোগীরা পানি সংগ্রহের জন্য প্লাটফর্ম তৈরির কাজ। অপরদিকে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৫০০ ফুট গভীর ৬টি টিউবওয়েল স্থাপনের কার্যাদেশ দেয়া হয়। একেকটি টিউবওয়েল তৈরিতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ লাখ টাকা।
বান্দরবানে পুরনো প্রকল্প সংস্কার দেখিয়ে বিল উত্তোলন: এছাড়া প্রতিটি টিউবওয়েলের জন্য ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি করে সাবমারসিবল পাম্প মোটর এবং ৫ লাখ টাকার ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ক্রয় দেখানো হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের স্থানগুলো হচ্ছে- বালাঘাটা পুলিশ লাইনে দুটি, কালেক্টরেট স্কুলে একটি, পুলিশের সার্কেল অফিসে একটি, জেলা কারাগারে একটি ও ফায়ার সার্ভিস এলাকায় একটি। ইসলামপুরের বাসিন্দা মৃদুল কান্তি দে অভিযোগ করে বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে দুটি সাবমারসিবল পাম্প মোটর দেয়া হয়েছে। একটি রিজার্ভারের মধ্যে রয়েছে, আরেকটি মোটর দিয়ে সাঙ্গু নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হয় উপরের ক্লিনিং ট্যাংকে। প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি পরিবারের ব্যবহারের জন্য সামান্য পাইপলাইন স্থাপন করে পালিয়েছেন ঠিকাদার। আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য কোনো পাইপলাইন স্থাপন করা হয়নি। স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগেই পাইপলাইন টেনে পানি ব্যবহার করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, উজানীপাড়ায় জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের পুরনো একটি পাম্প হাউস ছিল। সেটি সংস্কারের মাধ্যমে নতুন করে রং লাগিয়ে প্রকল্পের পুরো অর্থই লোপাট করেছেন ঠিকাদার। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী বলেন- প্রায় ৩০ বছর আগের তৈরি করা অকাঠামো প্রযুক্তি দিয়ে এখনও চলছে পৌর পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ। যে কারণে পৌরবাসীর পানি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
এ সকল অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার আখড়া হয়ে উঠেছে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
চোখ রাখুন পরের পর্বে…